কিচ্ছা বলার গ্রমীণ বৈঠক
লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির একটি বড় উপাদান মনে করা যেতে পারে কিসসা পালা। কিসসা পালাকে গ্রামীণ জনপদের মানুষ বিশেষ করে ময়মনসিংহ ও পূর্ব ময়মনসিংহের অর্থাৎ নেত্রকোণা অঞ্চলের মানুষ 'কিচ্ছা গাওয়া' বলে অবহিত করে থাকেন। এর কারণ হতে পারে- এই অঞ্চলের মানুষ দিনে কিংবা রাতের অবসর সময়ে বাড়ির উঠানে, আগলা ঘরে,গাছতলায়,বাড়িবারান্দায় বা যে কোন খালি জায়গায় ৪/৬,১০/ ১২ জন অথবা ততোধিক লোকজন একত্রে বসে শুরু করেন কিচ্ছা বলা। এই জন্যেই হয়তো গ্রামের মানুষ একে 'কিচ্ছা বলা' বলে থাকেন।
পরবর্তী সময়ে বাদ্যযন্ত্রসহকারে মঞ্চাসর করে কিসসা পরিবেশন শুরু হলে নতুন নামে পরিচিত হয়ে উঠে পালাগান হিসেবে। ময়মনসিংহের লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতির এই আঙ্গিক দুই ভাগে বিভক্ত হতে দেখা যায়। এর একটি হলো-গায়েনের বা বয়াতির বয়ানে,গানে-ছন্দে,নৃত্যে, অভিনয়ে, মঞ্চাসরে দাঁড়িয়ে,বাদ্যযন্ত্রসহকারে গাওয়া পালাগান বা কিসসা পালা পরিবেশন।
অপরটি হলো, গ্রামের বাড়ির আঙ্গিনায় বা উঠানে ধাড়ি,চট, পিঁড়ি অথবা মাদুর বিছিয়ে বৈঠকী কিচ্ছা- কাহিনী পরিবেশন।
এধরণের কিচ্ছা পরিবেশনে কোন মঞ্চ,বাদ্যযন্ত্র বা লাইট-বাতির প্রয়োজন হয় না। একজন কিচ্ছা-কাহিনী বলুয়া এবং বাকিরা থাকেন শ্রুতা। এক সময় শ্রুতার সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়। এমন কিচ্ছা বলুয়া প্রত্যেক গ্রামেই একাধিক জন থাকতেন। বৈঠককে জমিয়ে তুলতে কিচ্ছা বলুয়া বলতেন-" কিচ্ছা বড় কিস কিসানি শুনতে বড় ভয়, একজন ঘরে একজন বাইরে কিচ্ছা কেমনে অয়"।
কিচ্ছা বলুয়াদের মধ্যে যার বলার বাচন-ভঙ্গি, সুরের মাধুর্য,ধারাবর্ণনা,কাহিনীর যোগসূত্র, প্রকাশভঙ্গি এবং তথ্য-উপাত্ত দিয়ে রস বিন্যাসের মাধ্যমে সুন্দর ও আকর্ষনীয় করে উপস্থাপন করতে পারতেন তার জনপ্রিয়তাই ছিল বেশী। কিচ্ছা ওয়ালাদের মধ্যে এমনও ছিলেন যিনি অর্ধ্ব শতাধিক কিচ্ছা বলতে পারতেন। কৃষক বাড়িতে রাতে 'ধান মারা' ধান ঝারা,ফেলানোর সময় অথবা ধান উনা (ধান সিদ্ধ) করার সময় হুক্কা চোঙা নিয়ে তামাক টানা ও কিচ্ছা বলার যেনো রেওয়াজই ছিল এক সময়। তাদের এমন বৈঠকী কিচ্ছা শোনার জন্য অন্য পাড়া হতেও শ্রুতা আসতেন। তারা কেউ এ্যাবারিটি টর্সলাইট কেউ বা পাটখড়ির বুইন্দা (পাটশলা) জ্বালিয়ে এসে গভীর রাত পর্যন্ত কিচ্ছা-কাহিনী শুনতেন। ছোট বেলায় এমন উঠান বৈঠকী বহু কিচ্ছা-পালা বা কাহিনী গল্প শুনার সুযোগ আমার হয়ে ছিল। গৃহস্থবাড়ি হওয়ায় এমন বৈঠক প্রায়সই আমাদের বাড়িতে হতো।
এছাড়াও স্বাধীনতার পরও এমন বৈঠকী কিচ্ছা প্রায় গ্রামেই শোনা গেছে। তবে এখন আর তা নেই। শুধু বৈঠকী কিচ্ছাই নয়। বর্তমানে পালাগান (কিসসা) পরিবেশনও বহুলাংশে কমে গেছে। এক সময় প্রচুর পালাগান শুনেছি-ইসমাইল বয়াতি,দেশ বিখ্যাত কুদ্দুস বয়াতি,আবদুল জব্বার বয়াতি,আবদুল হেকিম বয়াতি,মনসুর বয়াতি,সবুজ বয়াতি প্রমুখগণের মুখে। তাদের বিচিত্র পোশাক,লম্বা চুল,বৈচিত্রপূর্ণ লোকজ বর্ণনাছটায় এবং ব্যাতিক্রমি সুর,লয়,তাল,ভঙ্গি, নৃত্য, অভিনয়শৈলির মাধ্যমে কাহিনীকে ফুটিয়ে দর্শক-শ্রুতাকে বিমোহিত করে তারা রাতভর পরিবেশন করেছেন পালা- কমলা রাণী,আপন দুলাল,বৈরাম খাঁ,জাহাঙ্গীর বাদশা,ভারমতি,ফিরুজ খাঁ দেওয়ান, বিরঙ্গনা সখিনা,আয়না বিবি ইত্যদি কিসসা পালা। তারা সবাই পেশাদার পালাগায়ক।তারা বাদ্যযন্ত্রসহকারে মঞ্চাসরে দাঁড়িয়ে সুর ছন্দে কথামালায় পালাগান পরিবেশন করেন।
অপর দিকে বৈঠকী অপেশাদার কিচ্ছা বলুয়াগণ মূলত সৌখিন।তারা কেউ কৃষক,ব্যবসায়ী,কেউ চাকরিজীবি,কেউ কৃশি শ্রমিক অথবা কেউ জনমজুর। যাদের কিচ্ছা শুনেছি তাদের অনেকেই বর্তমানে প্রয়াত।কিচ্ছা বলুয়াদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- সুলতান উদ্দিন, বুড়াদ্দা,ধরণী কান্ত,বিপিন শীল,সাধন বাবু,গোপাল সাহা,হাদিস মিয়া,সুনীল বিশ্বাস,মঞ্জু মিয়া প্রমুখ। তারা যে কিচ্ছা বলেছেন তা হলো- সাত আহম্মকের কিচ্ছা,যেমন কর্ম তেমন ফল, বন্ধু আমার বন্ধু,জাদুকর ও রাজকন্যা,কুজোঁ বুড়ির ছাগল,কমলারাণীর দীঘি,রাম বিরাম,সীতাহরন, ধর্ম বড় না কর্ম বড়, সৎমা'র ষড়যন্ত্র,কঙ্ক-লীলা,সূচরাজার কাহিনী, কূড়াশিকারী ইত্যাদি কিচ্ছা।
এমন কিচ্ছা বলুয়াদের কথার যাদু ও বলার ভঙ্গিতে শ্রুতাগণ আকৃষ্ট হতেন। কৌতুহল হতো এর পর কি হয় জানার জন্য। তারা শ্রুতাদের হাসাতে ও কাঁদাতেও পারতেন। এদের কেউ আবার শহরেরর সিনেমা হল থেকে সিনেমা দেখে এসে সেই কাহিনীকিচ্ছার মত বর্ণনা করতেও শোনা গেছে। বর্তমান সময়ে আধুনিকায়ন ও বিনোদনের সহজলভ্য প্রচুর মাধ্যমের কারণে বিলুপ্ত হয়ে গেছে গ্রামীণ খেলাধুলার পাশাপাশি আড্ডা বা কিচ্ছা বলার বৈঠকী আসর।এখন আর গ্রামাঞ্চলে কাজ শেষে গোলকরে বসে কিচ্ছা বলতে শোনা যায় না। তবে এখন গোল করে বসে টাচ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বিভিন্ন খেলা-ধুলাসহ হেইম খেলতে অনেককেই দেখা যায়।
আরও পড়ুন: শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই গড়ে উঠবে উন্নত-সমৃদ্ধ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’: রাষ্ট্রপতি
পর্ব-২০