শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১

দুর্জয় বাংলা || Durjoy Bangla

আধুনিক কলুর বলদ

সমাজ

প্রকাশিত: ২১:১৬, ২৭ এপ্রিল ২০২৩

আপডেট: ১৬:২৬, ২৮ এপ্রিল ২০২৩

আধুনিক কলুর বলদ

আধুনিক কলুর বলদ

নিজের বুদ্ধিশিুদ্ধি অতটুকু নেই। তাই তারাপদ রায়ের ‘বুদ্ধি শুদ্ধি’ থেকে ধার করা একটি গল্প শোনাই। জীবজগতের আজব কথা শিরোনামের লেখায় তারাপদ রায় গল্পটি এভাবে বলেছেন-“ এ কাহিনী অনেকদিন আগেকার। আমাদের অল্পবয়সের পাড়াগাঁয়ের গল্প। এ গল্পটি খাঁটি সরষের তেলের যুগের। ভেজাল রেপসিডের যুগে এ গল্প বিশ্বাস করা কঠিন।


আদ্যিকালের এক কলুর বলদ। সকাল থেকে সে ঘানি ঘোরাচ্ছে তো ঘোরাচ্ছেই। তর দু চোখ ঠুলি বাঁধা, ডাইনে-বাঁয়ে কিছুই সে দেখতে পারছে না। একটু দূরে দাঁড়িয়ে কলু মশায় মাঝে মধ্যে চেঁচাচ্ছেন ‘এই মোংলা’ এই রবি, এই ভোমলা, এই সাধু জোরে ঘোর, জোরে পাক দে।’সে চিৎকার শোনে বলদ টা মাঝে মাঝে তার চলার গতি বাড়াচ্ছে।


রাস্তা দিয়ে এক ভদ্রলোক যাচ্ছিলেন। তিনি পথের ধারে কলু মশায়ের বাড়ির সামনে একটা ঝাঁকড়া আম গাছের তলায় দাঁড়িয়ে বিশ্রাম করতে করতে বলদ –মানুষের এই নাটক দেখছিলেন। কিছুক্ষণ দেখার পর সেই ভদ্রলোকের মনে একটু সন্দেহ দেখা দিল, তিনি কলু মশায়কে বললেন,‘ আচ্ছা আপনার বলদটাকে আপনি এই যে চার পাঁচটা নামে ডাকছেন, এর কি সত্যিই এতগুলো নাম । ‘হাতের থেলো হুঁকো টানতে টানতে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে কলু মশায় বললেন‘ একটা বলদের ক’টা নাম রাখব ? ওর একটাই নাম। ওর নাম মোংলা।’


পথচারী ভদ্রলোক অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘ তাহলে ওকে এতগুলো নামে ডাকছেন কেন ? এই জিজ্ঞাসা শুনে কলু মশায় পথচারীর কাছে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললেন, এ দিকে একটু গাছের আড়ালে আসুন, আপনাকে বুঝিয়ে বলছি। কিন্তু মোংলা জানতে পারলে সর্বনাশ হবে।’ হতবাক পথচারীকে একটা বড় তেঁতুল গাছের আড়ালে নিয়ে গিয়ে কলু মশায় বললেন, ‘দেখুন ওর নাম মোংলা। কিন্তু ওর চোখে তো ঠুলি বাঁধা। ওতো আশেপাশে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। তাই আমি যখন এই মোংলা, এই রবি, এই সাধু, এই সব বলছি, ও ভাবছে ও একাই ঘানি টানছে না ওর সঙ্গে আরো অনেক বলদ রয়েছে, এতে ও মনে ফুর্তি পায় গায়ে জোর পায়। আরো শক্তি দিয়ে ঘানি টানে।”


আদ্যিকালের এসব গল্প শোনার মানুষ এখন নেই। বিলুপ্তপ্রায় তেলের ঘানি। কলু মশায় এখন কোম্পানী লিমিটেড। হতবাক পথচারী আর কোথায় পাবেন ? পথচারীর চোখ এখন ফেসবুক,টুইটারে। লাইক আর কমেন্টে পথচারী এখন নিভৃতচারী কমেন্টেটর। নির্বোধ বলদ মোংলা বহাল তবিয়তে ঘানি টেনে যাচ্ছে। সারা পৃথিবী জুড়ে। ঝাঁকড়া আম গাছ কবেই কেটে ফেলা হয়েছে। তেঁতুল গাছের যায়গায় ময়দানবের মত দাঁড়িয়ে রয়েছে হাইটেক পার্ক। কলুর বলদ মোংলা ছদ্ম বেশে ঘানি টেনে বেড়াচ্ছে এসব কলকারখানায়, অফিস আদালতে।


মোংলাকে আধুনিক কলুর বলদ আর সময়কে কলু ধরলে মরচে ধরা ঘানিটা ঘোরানো সহজ হবে। এখনও সমাজে ছেলে শিশুকে ভবিষ্যতের সম্পদ ধরা হয়,মেয়েশিশুর তুলনায়। যদিও এর ব্যতিক্রম রয়েছে। তবে তা খুবই কম। মোংলাকে ছেলে শিশু ধরলে তার জন্মের কারণ অবশ্যই আনন্দের। মা-বাবা, বাই-বোন আত্মীয়-স্বজন সবার কাছে। দায় নেই, আছে আয়ের সম্ভাবনা। আধুনিক মোংলা বড় হয়ে ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়িার, এমপি-মন্ত্রী কেউকেটা গোছের হবে এই আশাবাদ অনেকেই করতে পারেন। তখন তার কাছ থেকে অনেক সুবিধা পাওয়ার অগ্রীম বাসনা অনেকেই জমিয়ে রাখতে পারেন মনের বাক্সে। সে কারণে আধুনিক মোংলা জন্মের পর একটি নয় পায় অনেক নাম। মা বলেন এ আমার ‘সোনা’, বাবা ডাকেন এ আমার ‘হীরা’, বোন ডাকেন এ আমার‘মানিক’ খালা বলেন এ আমাদের ’হিরো’। পরিবারের গন্ডি পেরিয়ে অন্যান্য শুভার্থীরা নামকরণ করতে পিছপা হোন না।


জন্মের পরপর দেয়া নামগুলো মুখে মুখে থেকেই যায়। বিশেষ করে আধুনিক মোংলা ব্যাচেলর থাকা অবধি। মোংলা বড় হতে থাকে সবার আদরে-সোহাগে। সোহাগ- আদর পেয়েই সে খালাস। সোহাগের হিসাব যে রাখতে হয় সে তা বোঝে না। কিন্তু অন্যরা হিসাব রাখে। মোংলার মা সোনাকে একনজর না দেখলে পাগল হয়ে যান। আমার সোনা কই ? এই সোনা ই যে তার জীবনের অবলম্বন। বাবা বাসায় ফিরেই হীরার খোঁজ নেন। হীরা খেয়েছে ? এই হীরেই যে তার শেষ বয়সের লাঠি। বোনের কাছে মানিক অমূল্য ধন। রাক্ষুসে সমাজের কাছ থেকে এই মানিকই তাকে আগলিয়ে রাখবে। অপুত্রক খালার কাছে হিরোর মূল্য কতটুকু তা খালাই জানেন। এক মোংলার কত নাম, কত আদর ! এত আদর সইতে পারবে মোংলা ? মোংলা যে ঘানি টানার জন্যে বড় হচ্ছে তা কি সে জানে ? জানে না। তবুও প্রকৃতির নিয়মে মোংলা এখন ঘানি টানার জন্যে প্রস্তুত।


মোংলার চোখে এখনও ঠুলি পরানো। চারপাশের কোনকিছুই সে দেখতে পায় না। আধুনিক মোংলার চোখে ভালোবাসার ঠুলি পরানো। সমাজের বাহিরের চেহারাটা সে দেখছে। ভেতরের অবস্থা দেখার সুযোগ হয়নি। তাই সে আহ্লাদের বিভিন্ন নামডাক শোনে আপলুত। জোরসে টানছে ঘানি। তেল ঝরছে বেহিসেবে। আদর- সোহাগের হিসাব যেভাবে সে রাখেনি, তেলের হিসাব যে রাখতে হবে সে একবারও ভাবেনি। এই মোংলা ঘানি টানছে শহরে, বন্দরে, জাহাজে, ট্রেনে, বিমানে। খাঁটি তেল পাচ্ছে সবাই, ভালোবাসার পরিমাপে। জন্মের সময়ে যারা ছিল না, মোংলার ঘানির পাশে তারাও খোলেছে ভালোবাসার দোকান। ঠুলি পরা চোখে মোংলা কি তা দেখতে পায় ? আর দেখার সময় কি আছে ? এখন যে তেল আহরণ আর বিতরণের সময়।


সময়ের স্রোতে ভেসে আসে আধুনিক মোংলার সঙ্গী। আধুনিক সঙ্গী। তেলের হিসাব রাখার সঙ্গী। ভালোবাসার হিসাব রাখার সঙ্গী। মোংলার কলুর সংখ্যা বাড়ে। আদ্যিকালের মোংলার সঙ্গী ছিল কতগুলো নাম। তারা ও ঘানি টানত। ভরসা পেত অবোধ মোংলা। আধুনিক মোংলার সঙ্গী এখন দৃশ্যমান। তাও একজন। সে ঘানি টানতে চায়না। সে তেল মাখতে পছন্দ করে। সব তেল তার চাই। মোংলার তেলের ভাগ সে কাউকে দিতে চায় না। সুসময়ের কলুরা অনেকেই বিদায় নিয়েছে। বিপন্ন আপন কলুরা মালিকানা ছাড়তে নারাজ।


তেল প্রাপ্তি- পরিশোধে বিশাল সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। সমস্যা বাড়তে থাকে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। মোংলার তেজ কমছে দিন দিন। কমছে তেলের যোগান। আধুনিক মোংলার মাথায় ঢুকেছে হিসাব-নিকাশ। ভালোবাসার হিসাব, তেলের হিসাব, কলুর হিসাব। কিন্তু বড্ড দেরী করে ফেলেছে সে। ফেরার যে রাস্তা নেই। টান-পোড়নের এই সময়ে কেউ আর সোনা, হীরা, মানিক, হিরো বলে ডাকে না। পূরোনো আদর- সোহাগ এর মাশুল সুদ সমেত ফেরৎ চায় সকলে। নতুন কলু নতুন অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চায় বারেবার। আধুনিক মোংলা এখন বড় অসহায়। অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় নতুন বলদের সন্ধানে তার সঙ্গী। বলতে গেলে কলুবিহীন অপদার্থ বলদ আধুনিক মোংলা। সময় এবং নিয়তিই এখন তার কলু। ঘানি টানার তেজ তার নেই। দিন শেষে আধুনিক মোংলা কলুবিহীন দূর্বল বলদ। একটিই নাম মোংলা। এখন সে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ডায়েরী পড়ে। ০২-০৪-১৯৯৩.“এত কম সামাজিক সমঝোতা যে, মৃত্যুর পর চারজন শববাহক জুটবে, আশা করি না।”
আসলে সমাজিক সমঝোতা কি দিনদিন কমে যাচ্ছে ? না আমরা নিজেরা কমিয়ে দিচ্ছি। সমঝোতা কী কোনকালে ছিল ? দু একজন কলুর বলদ এই লেখাটা না পড়েই ,জীবন থেকে এর উত্তর দিতে পারবেন। সত্যিকার অর্থে সমঝোতা কোথাও ছিল না কোনকালে। এখনও নেই।


তবে সামাজিক সমঝোতার সংজ্ঞাটা পাল্টেছে কালে কালে। তাই সন্দীপন বাবুরা ডায়েরীর পাতায় এমন করুণভাবে লিখে যান। আর আমরা বলদের মৃত্যুর পর, কৃত্রিম চোখের জলে চামড়াটা বিক্রি করি। কলুর বলদের ঘানিটানা তেলের খুশবু পাই তারই চল্লিশার বিরিয়ানীতে।


বিঃদ্রঃ আধুনিক মোংলাদের নিরাশ করার জন্যে আমার এই লেখা নয়। যদি দেখতে পান আপনার আশেপাশে কলুর বলদের সংখ্যাটাই বেশী, তবে আপনিও তেজের সহিত টানুন ঘানি। সভ্যতা এইভাবে কলুর বলদের শ্রমেই এতদূর এগিয়েছে, এগিয়ে যাবে। এই লেখার সঙ্গে সেইসব বলদের সম্পৃক্ততা নেই যারা সামর্থ্য থাকা সত্বেও ঘানি টানে না। কলুর কাছে বোঝা হয়ে থাকে। সেই সব বলদ যারা উচ্ছন্নে গেছে। মহাদেবের ষাঢ় হয়ে ঘোরায়, আর বৃদ্ধ কলুর জন্যে যন্ত্রণা বয়ে আনে। অথবা বিশিষ্ট বলদ যারা বাছুর থেকে বলদ হয়ে কলুকে ভুলে যায়। হাড্ডিসার কলু বুকের পাঁজর বের করে নিজের ঘানি নিজেই টেনে চলেছে তাদের জন্যে, তারাপদের আরেকটি গল্প:
“ক্যাঙারু মা বাস থেকে নেমে ক্যাঙারু বাবাকে বলল ‘সর্বনাশ হয়েছে। খোকা পকেটে নেই। আমাদের খোকা এইমাত্র পকেটমারি হয়ে গেল।”

আরও পড়ুন: রাবণের অশোক বনে তোরাব খাঁ

রম্যলেখক

শীর্ষ সংবাদ:

ঈদ ও নববর্ষে পদ্মা সেতুতে ২১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা টোল আদায়
নতুন বছর অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রেরণা জোগাবে: প্রধানমন্ত্রী
কলমাকান্দায় মোটরসাইকেলের চাকা ফেটে তিনজনের মৃত্যু
র‌্যাব-১৪’র অভিযানে ১৪৫ পিস ইয়াবাসহ এক মাদক ব্যবসায়ী আটক
সবার সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করুন: প্রধানমন্ত্রী
ঈদের ছুটিতে পর্যটক বরণে প্রস্তুত প্রকৃতি কন্যা জাফলং ও নীল নদ লালাখাল
কেন্দুয়ায় তিন দিনব্যাপী ‘জালাল মেলা’ উদযাপনে প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত
ফুলবাড়ীতে ঐতিহ্যবাহী চড়কসহ গ্রামীণ মেলা অনুষ্ঠিত
কেন্দুয়ায় আউশ ধানের বীজ বিতরণ ও মতবিনিময় অনুষ্ঠিত
কলমাকান্দায় দেশীয় অস্ত্রসহ পিতাপুত্র আটক
ঠাকুরগাঁওয়ে গ্রামগঞ্জে জ্বালানি চাহিদা পূরণ করছে গোবরের তৈরি করা লাকড়ি গৃহবধূরা
ফুলবাড়ীতে এসিল্যান্ডের সরকারি মোবাইল ফোন নম্বর ক্লোন চাঁদা দাবি: থানায় জিডি দায়ের
ফুলবাড়ীতে সবজির দাম উর্ধ্বমূখী রাতারাতি দাম বাড়ায় ক্ষুব্ধ ভোক্তা
ধর্মপাশায় সরকারি রাস্তার গাছ কেটে নিলো এক শিক্ষক
সাঈদীর মৃত্যু নিয়ে ফেসবুকে ষ্ট্যাটাস দেয়ায় রামগঞ্জে ছাত্রলীগ নেতা বহিস্কার
বিয়ের দাবিতে প্রেমিকের বাড়ীতে অনশন
মসিকে ১০ কোটি টাকার সড়ক ও ড্রেনের কাজ উদ্বোধন করলেন মেয়র
কলমাকান্দায় নদীর পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু
বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী বাঁশ-বেত শিল্প
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক যতীন সরকারের জন্মদিন উদযাপন
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ যতীন সরকারের ৮৮তম জন্মদিন আজ
১ বিলিয়ন ডলার নিয়ে এমএলএম mtfe বন্ধ
কলমাকান্দায় পুলিশের কাছে ধরা পড়লো তিন মাদক কারবারি
আটপাড়ায় জিপিএ-৫ প্রাপ্ত ১০৩ জন কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা
নকলায় ফাঁসিতে ঝুলে নেশাগ্রস্থ কিশোরের আত্মহত্যা
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ নুরুল ইসলামের রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস
কলমাকান্দায় আগুনে পুড়ে ২১ দোকানঘর ছাই

Notice: Undefined variable: sAddThis in /home/durjoyba/public_html/details.php on line 809