রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছবি: সংগৃহীত
কেমন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
জন্মের এত বছর পরেও এই প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক। ডাঙায় হাতির চেয়ে বড় প্রাণী যেমন নেই তেমনি বাংলায়, বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের ধারে কাছে এখনো কেউ নেই। তাই রবীন্দ্রনাথ অনেকটা অন্ধের হস্তী দর্শনের মত। যে যার মত ব্যাখ্যা করেছে,করছে এবং করতেই থাকবে।
রবীন্দ্রনাথ ভক্তের কাছে একরকম ,তার বিরোধীর কাছে আরেক রকম। হিন্দু-মুসলমান ব্রাহ্ম একেকজনের কাছে এক একরকম। ঘরের মানুষের রচনাতেই আমরা পাই নানান রকম রবীন্দ্রনাথের ছবি। আসলে এটাই রবীন্দ্রনাথের বিশ্বরূপ।
হঠাৎ দারুণ তৃষ্ণা পেল। যে সে তৃষ্ণা নয়। পিপাসায় গলা ফাটে। আমার মাথা ফেটে যাচ্ছিল। মৃণালিনী দেবীর মূল নাম মনে করতে পারছি না। কী যে যন্ত্রণা হয় পরিচিত নাম ভুলে গেলে বুঝাতে পারব না। একবার ভাবি বাসের হেল্পার ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করি। আরেকবার ভাবি পাশের সহযাত্রী বোরকাপরা মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করি। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনীর আসল নাম তুমি জান? নিজের বোকামীর জন্য লজ্জা হয়। গুগল থাকতে এত কষ্ট কেন? গুগল বলল ,মৃণালিনী নয় ভবতারিণী ১লা মার্চ, ১৮৭৪
দক্ষিণডিহি, খুলনা জেলা, বাংলাদেশে জন্ম।
জোঁড়াসাকো ঠাকুরবাড়ি, কলকাতা গিয়ে ভবতারিণী হলেন মৃণালিনী। রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীর অভিজাত নাম দিলেন। কতজন এ নিয়ে গল্প উপন্যাস লিখলেন। গরীবের নাম তাও কেড়ে নেয় বড়লোকেরা। কিন্ত এই মৃণালিনী নিজের গহনা বিক্রি করে শান্তি নিকেতনে লাগালেন। পুত্র রথীন্দ্রনাথ তার "আমার পিতা রবীন্দ্রনাথ" বইয়ে তা লিখেছেন। কিন্ত বাম আর দলিত সম্প্রদায়ের বর্ণ ব্যবসায়ীরা তা মানতেই চায় না। বলে না না এসব প্রেম ট্রেম লোক দেখানো। রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীর প্রতি অবিচার করেছেন। স্ত্রীকে যথাযথ মূল্যায়ন করেননি রবীন্দ্রনাথ।
পুত্র রথীকে জীবনের দীক্ষা দেয়ার জন্য শান্তিনিকেতনে আরও আটদশ ছাত্রের মত গরিবী খানা খেতে অভ্যাস করিয়েছেন। জীবন পুষ্পশয্যা নয় জানিয়ে দিতে বালক রথীকে পাঠিয়েছেন কেদারনাথ দর্শনে। দুইশ মাইল পাহাড়ী পথ হেঁটেছে জমিদার পুত্র জীবনকে জানতে।
জীবন কে চ্যালেঞ্জ করতে নিজে সাঁতরিয়ে পার হয়েছেন উত্তাল গড়াই নদী। নৌকা থেকে নদীতে ফেলে দিয়েছেন কিশোর পুত্র রথীকে, আয় সাঁতার কেটে আয়। জীবনের সাথে প্রকৃতির সাথে যিনি পুত্রকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। জমিদারী চালাচ্ছেন। ঠাকুর বাড়ির একপাল লোকের অন্নের সংস্থান করছেন। দুই হাতে লিখেছেন তিনি কেমন রবীন্দ্রনাথ?
ইন্দিরাকে লেখা ছিন্নপত্রে চেনা যায় বাংলাদেশের রবীন্দ্রনাথ। বাংলার অপরূপ প্রকৃতি ধরা পড়েছে রবীন্দ্রনাথের কলমে।
বঙ্কিমের বন্দে মাতরম শব্দ দুটিকে প্রথম সভা সমিতির শ্লোগান হিসেবে ব্যবহার করেছেন রবীন্দ্রনাথ। ভারতের স্বরাজ ও স্বদেশী আন্দোলনে আগুন ধরিয়েছে বঙ্কিমের এই শ্লোগান। কিন্ত রবীন্দ্রনাথ কোন স্বদেশীকে বলতে পারেননি, চল আজ পুড়িয়ে দিয়ে আসি ব্রিটিশদের ঘর। সৃষ্টির আনন্দে মাতোয়ারা রবীন্দ্রনাথ শত্রুকে আঘাত করতে জানতেন না। আমার বাউল শাহ আবদুল করিমও একই কথা বলেন, আর কিছু চাই না মনে গান ছাড়া। তাঁর গান কে তিনি সব সৃষ্টির উপরে রেখেছিলেন। লালনের মত রবীন্দ্রনাথ বাউল ছিলেন তবে আউল ছিলেন না বলে জমিদারী টিকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। উদার ছিলেন কিন্ত সবার খাজনা মাপ করেননি।
এসব হাজার প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসবে। এক বৈশাখ যাবে আরেক বৈশাখ আসবে। এক প্রজন্ম বিদায় নিলে নতুন প্রজন্ম হাল ধরবে। কিন্ত থেকে যাবেন রবীন্দ্রনাথ। বাঙালির প্রজন্ম থেকে প্রজন্মাতরে প্রশ্ন করে যাবে? কেন এত রহস্যাবৃত এই ঋষি! কেমন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
স্রেফ অভিনয় নয়। নিজে নাটক লিখে নিজে অভিনয় করে যে টাকা রোজগার করা যায় বাঙালিকে তাও শিখিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথ সবচেয়ে বেশী ভালোবেসেছেন নিজেকে। নিজের কাজকে। যা গোঁ ধরেছেন তা করেই তবে ছেড়েছেন। যা করতে চাননি মহাত্মা গান্ধীর মত লোকও অনুরোধ করে করাতে পারেন নি। তাই এক অর্থে রবীন্দ্রনাথকে গোঁয়ার বলা যেতেই পারে। এই সৃষ্টিশীল গোঁয়ার না এলে আমরা বাঙাল মানুষ হতাম কার গান শুনে?
বাস্তবিকতার বাইরে যাওয়াকে পছন্দ করতেন না রবীন্দ্রনাথ। ব্রিটিশদের দেওয়া নাইট পদবী ত্যাগ করলে ব্রিটিশ সরকারের সাথে তার সম্পর্কের অবনতির প্রকাশ্য নজির নেই। দেশপ্রেম নিয়ে দুর্দান্ত গান লিখলেও রবীন্দ্রনাথ কোন যুবককে সরাসরি যুদ্ধে যাওয়ার কথা বলেননি। স্বদেশীদের বলেননি যাও ছিনিয়ে নিয়ে আসো স্বাধীনতা। প্রয়োজনে রক্তগঙ্গা বইয়ে দাও। তিনি বরঞ্চ যুবকদের বলতেন এসব রকবাজি বাঙালির সংস্কৃতির সাথে যায় না। ধারাবাহিক সুস্থ আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতীয়রা তার অধিকার অর্জন করতে পারে এই ছিল তার বিশ্বাস।
রবীন্দ্রনাথ সকল যায়গাতেই ছিলেন। আবার কোন কিছুতেই তিনি নেই। অস্পৃশ্যতাকে পছন্দ করতেন না তিনি। কিন্ত জাত পাত বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে চাইতেন না তিনি। ব্রাহ্মণ্যবাদ উদারবাদ রবীন্দ্রনাথের বিশাল আলখাল্লার নিচে আশ্রয় পেত। নারীর স্বাধীনতায় তার সম্মান ছিল। নিজের ছেলেকে বিয়ে দিয়েছেন বিধবা প্রতিমা দেবীর সাথে। আবার সমাজ লোকাচার মেনে নিজের বালিকা মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। একজন রবীন্দ্রনাথ কীরকম বিচিত্র রবীন্দ্রনাথ।
ভ্রমণের পিপাসা মিটেনি রবীন্দ্রনাথের। কারণে অকারণে সমুদ্রপথে পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েছেন ছয় সাত বার। ভ্রমণের অভিজ্ঞতার বর্ণনা ,চিঠিপত্র হয়েছে অনন্য সাহিত্য। কোথায় যাননি। আইনস্টাইন থেকে হিটলার কার সাথে দেখা হয়নি। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে যে ঘরে শেষ নিঃশ্বাস ফেলে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সে ঘরে যেন এখনো অতৃপ্ত রবীন্দ্রনাথ। যে ই দেখতে যাচ্ছে তাকে যেন বলছেন, আমাকে একটু শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে দে না। আমার তালগাছ, কোপাই নদী। কলকাতা ছাড়তেই আমি বোলপুরে শান্তিনিকেতন বানিয়েছিলাম। শান্তি তা আর পেলাম কই?
বাংলা ভাষার লোক হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে অবহেলা করা মানে নিজেকে ফাঁকি দেয়া। বটগাছ না চিনলে বৃক্ষ চেনা পূর্ণ হয়? হয় না। আমরা তাই আজকাল লতাগুল্মে জড়িয়ে পড়েছি। পুকুর কে সমুদ্র ভেবে অর্বাচীনদের কথায় রবীন্দ্রনাথ না পড়ে তাকে নিয়ে কুৎসা গাইছি।
রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের পক্ষে না বিপক্ষে ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে কতটুকু ভালোবাসতেন ? রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছিলেন কি না ? এসব প্রশ্নের উত্তরে যারা রবীন্দ্রনাথ কেমন ছিলেন তা প্রমাণ করতে চান তাদের বলব রবীন্দ্রনাথের গল্প উপন্যাস কবিতা গান নাটক ছবি প্রবন্ধ চিঠিপত্র পড়ুন তারপর রবীন্দ্রনাথকে মাপুন। বুকপকেটে রবীন্দ্রনাথ পড়ে নিজেকে সলিমুল্লাহ কিংবা ভীষ্মদেব ভাবলে ভুল করবেন। আপনার ভুলের মাশুল দিবে আপনার পরিমণ্ডল।
জমিদার নন্দন। কলকাতার সবচেয়ে কর্পোরেট এলিট বাড়ির প্রতিভাধর সন্তান, সৌম্যকান্তিময় রূপ রবীন্দ্রনাথের। কিন্ত তার লেখার সমালোচনা থাকলেও ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের চরিত্রের দোষ নিয়ে বানিয়ে লিখতে পারেননি কেউ। আর আমাদের সময়ে জি বাংলায় দু লাইন রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে একটু জনপ্রিয়তা পেয়ে কী না করছে নোবেল কৎবেলেরা। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির বলয় ভাঙ্গার জন্য অনেকেই তাকে প্রথম জীবনে অস্বীকার করেছেন। পরবর্তীতে যখন দেখেছেন রবীর কিরণ অস্বীকার করা বাঙালির জন্য মূঢ়তা ছাড়া আর কিছুই নয়। যেমন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করেছেন কিন্ত পরবর্তীতে তাকে নমস্য রেখেই নিজস্ব ধারায় বলীয়ান হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ চর্চা ব্যতিত তাকে জানার উপায় নেই।
জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ তার সাদা সিধা জীবনের বর্ণনা দিয়েছেন। বড়লোকের সন্তান হিসবে কোথাও অহমিকার ছিটেফোঁটাও নেই। মনের কিবা মতের মিল হয়নি যাদের সাথে তাদের কখনো অবজ্ঞা করেননি রবীন্দ্রনাথ। অথচ সচরাচর আমরা তাই করি। যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা। রবীন্দ্রনাথ বিপথগামীদের প্রতি খড়গহস্ত হননি কখনো। প্রতিবাদের পরিবর্তে প্রেমে সংশোধন চেয়েছেন। যেখানে সবকিছুই ব্যর্থ হয়েছে সেখানে করুণার আশ্রয় নিয়েছেন। আর তখনই সম্ভব হয়েছিল গীতাঞ্জলীর মত সমর্পণ কাব্য। পশ্চিমারা গীতাঞ্জলীর আবেদনকে বাইবেলের নিবেদনের সাথে গুলিয়ে ফেলেছিল। অমিত প্রতিভাধর রবীন্দ্রনাথ যথাসময়ে যথাস্থানে গীতাঞ্জলী পৌঁছাতে পেরে বয়ে এনেছিলেন নোবেলের সম্মান। সেই সময়ে কোন বাঙালির মাথায় এমন চিন্তাই ছিল না।
তার প্রতিটি ক্ষণ বৃহত্তর মানব কল্যাণে ব্যয় করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তবে তা শুধু কবিকল্পনায় নয় নিবিড় বাস্তবতায়।
আর বলতে হবে কেমন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ? বাঙালির আদর্শ, আপাদমস্তক বাঙালি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।