প্রসঙ্গ, রাজাকার মুক্ত বাংলাদেশ বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী
লেখা লেখি করা আমার একটা বদ অভ্যাস আছে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখার প্রবনতাটাই আমাকে দারুণ ভাবে পেয়ে বসেছে। ইতিহাসের ছাত্র হিসাবে ইতিহাসের প্রতি দুর্বলতাও রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখতে গিয়ে নিজের কথা নিজেই যখন লিখতে বসি তখন কিছু সমস্যা এসে ভীর জমায়। নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে অমেক সময় ব্যাক্তিগত পছন্দ অপছন্দ চলে আসে। তাই যতেষ্ট সতর্কতার সাথেই ইতিহাস লিখার চেষ্টা করতে হয়।
সমসাময়িক ইতিহাস চর্চা সহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের ইতিহাস চর্চার মুল লক্ষ্য হচ্ছে সত্য উদ্ধসঢ়;ঘাটন করা। কিন্তু আমরা অনেকেই সত্যের মূখামূখী হতে ভয় পাই। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের বাংলাদেশের রাজনৈতিক সামাজিক ঘটনাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করলে ভালোমন্দ মিলিয়ে অনেক চরিত্র বেড়িয়ে আসবে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী চরিত্রগুলো। এসব চরিত্রগুলো যদি আমাদের স্মৃতিতে জীবন্ত থাকে, কিংবা তাদের উত্তর সুরীরা চোখের সামনে চলাফেরা করে, তখন তাদের নিয়ে লিখতে গেলে বিব্রতকর অবস্থা কিংবা বিপদজনক নোংরা পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। কেননা অতীতের সত্য প্রকাশ হলে করো কারো বর্তমানটা ঝুঁকিতে পড়ে যাবে।
এমতাবস্থায় ইতিহাস লেখাও একটা কঠিন কাজ। তারপরেও লিখতে হবে, নতুবা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে সত্য মিথ্যার ক্রান্তিকাল থেকে আমরা বেঁরিয়ে আসতে পারব না। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসের পাশাপাশি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী চরিত্রগুলোর নাম পরিচয়সহ তাদের অবাঞ্চিত কর্মকান্ডের ইতিহাস জাতির সামনে তুলে ধরার দায়িত্ব নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে।
ইতিহাসের প্রয়োজনেই ইতিহাস লেখা হবে। কে খুশী হলো, কে বেজার হলো, সেটা ইতিহাসের বিবেচ্য বিষয় নয়। সময়ের সঙ্গে পাল্টা দিয়ে নানা ঘটনার জন্ম হচ্ছে। এসব ঘটনা বাহির থেকে দেখা যায় না। যারা রাজনীতিতে এখনো সক্রিয়, কিংবা আগে সক্রিয় ছিলেন, এখন নিষ্ক্রিয়, তারা অনেকেই ইতিহাসের শুধু সাক্ষী নন, তারাও ইতিহাসের চরিত্র এবং অনেকেই এর নির্মাতা। চলমান আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে এরা অনেকেই শহীদ অথবা মারা গেছেন। ফলে গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্যই চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে। যারা জীবিত আছেন তাদের অনেকেই মূখ খুলছেন না আত্মসম্মান ও নিরাপত্তার ভয়ে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিগুলোর উত্তরসুরীদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান অনেক শক্তিশালী, সাংগঠনিক অবস্থানও যতেষ্ট মজবুত। ওরা দৃশ্যমান রাজনীতির আড়ালে কল কাঠি নাড়েন, তাদের আসল চেহারা মঞ্চের উজ্জ্বল আলোয় সব সময় ধরা পড়ে না।
অথচ নেপথ্যে অনেক সর্বনাশী ভুমিকা পালন করে যাচ্ছে। স্বাধীনতা বিরোধী মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিগুলোর চিত্র অঙ্কন করে তাদের উত্তরসুরীদের রাজনৈতিক সামাজিক অবস্থান তুলে ধরে পরিচ্ছন্ন রাজনীতি ও নির্ভেজাল সত্যাশ্রয়ী ইতিহাস লিখতে হবে। ইতিহাসের পাত্র-মিত্রদের জীবদ্দশায় এসব ইতিহাস লিখে না গেলে পরবর্তীতে এর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস অনেকেই লিখছেন বা লিখবেন, নিজেদের বীরত্বপুর্ণ কাহিনী অবলম্বনে ইতিহাস লেখা হচ্ছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, আল-বদর, আল শামস, আল মুজাহিদ সহ শান্তি কমিটি, মুসলিম লীগ, জামায়েত ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও পাকিস্তান দরদী ব্যাক্তিবর্গের কর্মকান্ডের খতিয়ান সহ হত্যাকারী লুটেরা, অগ্নি সংযোগকারী, দখলবাজ, মা বোনদের ইজ্জত লুন্ঠনকারীদের চিহ্নিত করে, তাদের উত্তরসুরী খল নায়কদের মুখোশ উন্মোচন করে জাতির সামনে তুলে ধরা এখন সময়ের দাবী। এ দাবী পুরনে শুধু ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির একার কাজ নয়, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সমস্ত রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো সমন্বিত প্রচেষ্টা সহ স্বাধীনতা প্রিয় জাতিকেই দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই সম্ভব হবে রাজাকার মুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা।
৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি নামের এই সংগঠনটি স্বাধীনতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধী, দালাল, রাজাকারদের তালিকা প্রণয়নসহ তাদেরকে বিচারের আওতায় আনতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিগুলোর সমন্বিত জোরালো প্রচেষ্টা এখন আর আগের মত না থাকায় মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনীতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর রহস্যজনক নিরবতা ও যুদ্ধাপরাধী আন্তর্জাতিক বিশেষ ট্রাইবুন্যাল বিচারিক আদালতের কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়ায় চাপা পড়ে যাচ্ছে যুদ্ধপরাধীদের বিচার। সময়ের ব্যবধানে ইতিহাস এভাবেই চাপা পড়ে যায়। থেকে যায় শুধু স্মৃতি।
মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী এই সব দালাল রাজাকার ও হানাদার বাহিনীর দোসরদের পূর্ণ বিচারের মুখোমুখি দাঁড়া করানো এবং তাদের উত্তরসূরীদের চিহ্নিত করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে জানান দেওয়া এখন শুধু সময়ের দাবী নয়, এটা ইতিহাসেরও দাবী। এই দাবীকে সামনে রেখেই ৯০ দশকে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমের নাগরিকতা বাতিলের দাবীতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯শে জানুয়ারি ১৯৯২ সালে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করা হয়। এই নির্মূল কমিটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক শক্তিগুলোর সমন্বয়ে স্বাধীনতা প্রিয় জনগণকে সাথে নিয়ে ঢাকাসহ সারা দেশব্যাপী গণআন্দোলন গড়ে তুলে।
আন্দোলনকারী জনতা গণআন্দোলনের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দৃশ্যমান রায় কার্যকরের মহড়াসহ আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়। এই যুদ্ধাপরাধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদান কারী রাজনীতিক দল আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে সরকার গঠন করে। যুদ্ধাপরাধী বিচারে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী ট্রাইবুন্যাল গঠন করে বিচারের ব্যবস্থা করে। বিচারের রায় ঘোষণা হলে পরেও বিচারের রায় কার্যকরী করার ব্যাপারে সতর্ক অবস্থান নিয়ে নেয় আন্দোলনকারীরা।
পরবর্তীতে যুদ্ধপরাধীদের বিচারের ঐতিহাসিক রায় কার্যকর করার দাবীতে আন্দোলনকারী স্বাধীনতা প্রিয় ছাত্র জনতা ঢাকা শাহবাগ চত্বরে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবস্থান নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল আদালত জাতীয় পর্যায়ে যুদ্ধাপরাধী দেশদ্রোহী জামায়াত ইসলামী নেতা মাওলানা মতিয়র রহমান নিজামী, কাদের মোল্লা ও মুসলিম লীগ নেতা সাকা চৌধুরী সহ যুদ্ধপরাধীদের বিচারে রায় দ্রæত কার্যকরী করায় স্বাধীনতা প্রিয় বাঙালী জাতি স্বস্তির নিঃশ্বাস পেলে। দীর্ঘদীন পরে স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচারের রায় কার্যকরী হওয়ায় জনগণের মাঝে নেমে আসে আনন্দের জোয়ার। জনে জনে কোলাকুলি, রাজপথে আনন্দ মিছিল, মিষ্টি বিতরণ সহ ৭১ এর বিজয়ী জাতি তৃপ্তির ঢেকুর তুলে।
এইদিকে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে অনেক সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় কার্যকরী না হওয়ায় এবং বিচারিক আদালতের কার্যক্রম দীর্ঘসূত্রীতায় দরুন স্বাধীনতা প্রিয় জনগণের মাঝে এক ধরণের উদ্বেগ, উৎকন্ঠা দেখা দিয়েছে। ৭১ এর পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
অনেক সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী বিচারের রায় নিয়ে জেলহাজতে অথবা আত্মগোপনে থেকে ফেরারী হিসেবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্ম, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদ ও নতুন প্রজন্ম থেমে যাওয়া এই বিচারিক আদালতের কার্যক্রম পূণরায় চালু করার দাবীতে চলমান আন্দোলনকে গতিশীল করে আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে বিচারের রায় কার্যকরী করার জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকারের নিকট জোর দাবি জানিয়ে, যুদ্ধাপরাধী রাজাকার মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে আজ ২ সেপ্টেম্বর নেত্রকোণায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সম্মেলন। এই সম্মেলনের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকবেন।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সফল নেত্রী শহীদ জননী জাহানারা ইমাম-এর দেখানো পথে তারই সুযোগ্য সহযোদ্ধারা সারা দেশ সফর করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পাশাপাশি চলমান আন্দোলনকে আরো বেগবান করে রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলবে, এটাই সময়ের প্রত্যাশা।
লেখক: হায়দার জাহান চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক
আরও পড়ুন: নবাগত ওসি’র সাথে মধ্যনগর প্রেসক্লাবের সাংবাদিকদের মতবিনিময়