আমাদের দুর্গা পরিবার
সে অনেক দিন আগের কথা । বৈদ্যনাথবাটি অঞ্চল থেকে নৌকা যাচ্ছে কলকাতা অভিমুখে। পালতোলা নৌকা। পালে হাওয়া লাগায় মাঝি মনের আনন্দে গান ধরেছে-
মা বাহের ওপর তুমি খাড়ায়ে কি কর।
তীর দিয়ে ধরছ ঠেসে, সাপ দিয়ে কেমড়ায়ে সারো ।।
পক্ষীর উপর জুহা পায়, বাবুর মতন দেহা যায়,
তার পাশে ঐ ধবলা ছুঁড়ি, রাখতি পার কি না পার।
তার পাশে ঐ আঙা ছোঁড়া বোধ হয় যেন ঝি বৌ চোরা;
তার পাশে হলদি ছুঁড়ি –
ঐ অঞ্চলের ভাষা না জানা লোক গানের আগা মাথা না বুঝায় সহগামীকে জিজ্ঞেস করছে, ভাই কি গায় ?
সহগামী হেসে উত্তর দেন। শরৎ এসেছে। পূজার গন্ধ পান না। মাঝি গানে গানে দুর্গা প্রতিমার বর্ণনা করছে। আমরা যে দুর্গা মায়ের পূজা করি, এটা দুর্গা মায়ের পাবিারিক ছবির পূজা। একই ফ্রেমে স্বামী মহাদেব, পুত্র গণেশ, কার্তিকেয় কন্যা লক্ষ্মী, সরস্বতী আর পদতলে মহিষাসুর। সিংহবাহিনী মায়ের মত অন্যান্য দেবতাদের নিজস্ব বাহনও রয়েছেন ফ্রেমে। মূষিক, পেঁচা, ময়ূর হাঁস সবই আছে। কোন কাঠামোতে সখী জয়া ও বিজয়া থাকেন।
ইতিহাস বলে ১৬১০ সালে কলকাতায় সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার এই সপরিবার দুর্গার পূজা প্রচলন করেন। মহিষাসুরমর্দিনী মায়ের এই ছবি আজও পূজিত হচ্ছেন বিশ্বব্যাপী, যেখানে বাঙালি আছে। রাজা সুরথ বা রাজা রামচন্দ্রের পূজিত দুর্গায় এই কাঠামো ছিল বলে তেমন উল্লেখ পাওয়া যায় না।
পরিবার সমন্বিতা দুর্গার পূজার ব্যাখ্যা ছিল এরূপ মা দুর্গা স্বামীগৃহ কৈলাশ হতে পিতৃগৃহে স্বপরিবারে বেড়াতে আসেন। তাই রীতি অনুযায়ী আগত সকল অতিথির সেবা করতে হয়। পূজার বিধি অনুযায়ী সকল দেবতা পূজা পান।
দুর্গাপূজার প্রভাব বাঙালির পারিবারিক জীবনে পড়ে। পূজারীর কাজ হয় মন্ত্রপাঠে পূজা করা আর পূজার বাহিরের আয়োজন হয়ে দাঁড়ায় বাঙালির মূল উৎসব। দুর্গা পূজাকে আবর্ত করে বাঙালি সংস্কৃতি হয়ে ওঠে শারদোৎসব কেন্দ্রিক। বছরের ঐ সময়ের অপেক্ষায় থাকে সকলেই। ছুটির কাঙাল বাঙাল ছুটি জমায় পূজাতে কাটাবে বলে। পিতা প্রস্তুত হন মেয়েকে ঘরে আনবেন বলে , মেয়ে প্রস্তুত হন স্বামী সন্তান নিয়ে পিতৃগৃহে আসবেন বলে। পত্রিকার ব্যবসায়ী, প্রকাশক, লেখক ভালো গল্প জমিয়ে রাখেন পূজা সংখ্যায় বেচবেন বলে। আর যারা অন্যের টাকায় সর্বজনীন পূজা করেন তারাও অপেক্ষায় থাকেন পূজোটা আসল বলে! পদ-পদবীর পাশাপাশি পূজা শেষে হাতখরচা, এগুলো দেবীরই কৃপা। প্রসাদ ছাড়া ভক্ত, কোন দেবতা পেয়েছেন কোনকালে ?
শত শত বছরে বাঙালির পরিবার জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু দুর্গা পরিবার যেমন আছে তেমনই রয়েছে। প্যান্ডেলে পরিবর্তন এসেছে, প্রতিমার গড়নে হালফ্যাশন জায়গা পেয়েছে তাই বলে সপরিবার দুর্গা পরিবর্তিত হননি। বাঙালির পরিবারের সবছিুই ভেঙ্গে পড়েছে। যৌথ পরিবার আর নেই। দুর্গা পরিবারের মত চার সন্তানের পরিবারও মেলানো ভার। খুব বড়লোক হলে আর খুব ছোটলোক হলে, জীবন সম্পর্কে ধারণা না থাকলেই কেবল পরিবারে দুই এর অধিক সন্তান দেখা যায়। সন্তান সংকোচন নীতিতে বাঙালি এখন সিদ্ধহস্ত। স্বাস্থ্য আপাকে আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিবার পরিকল্পনার শিক্ষা দিতে হয় না। সন্তানের মর্ম বাঙালি বুঝে গেছে। এক মেয়ে, এক ছেলের সংসারে ও আনন্দ নেই। অভাব আর অভাব। ফুরায় না। খাদ্যের অভাব সারলে সাচ্ছন্দ্যের অভাব ভর করে। ছেলের কথা মা শুনে না, বাপের কথা মেয়ে ,আর স্বামী-স্ত্রী ,ভুল রাস্তায় মুখোমুখি হওয়া ব্রেকবিহিন দুটি গাড়ি। উচ্চবিত্ত কিংবা অন্ত্যজ সকল শ্রেণীর পরিবারে একই অবস্থা।
কলকাতার দুর্গাপূজাকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছে। মানবতাবাদী পূজা, নারীশক্তির জাগরণের পূজা,সামাজিক মেলবন্ধনের প্রতীক হিসেবে দুর্গাপূজার এ প্রাপ্তি। ইউনেস্কো তাদের ঘোষণায় কলাকাতার সকল বাঙালীকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। বিশেষ ধন্যবাদ জানিয়েছে তাদের যারা পূজার আয়োজন করেন। শিল্পী কুশলী, যারা সাজ সজ্জায়, চিন্তায় পূজাকে বাঙময় করে তোলেন।
আমাদের পূজিত দেবী দুর্গা মূলত মার্কণ্ডেয় পূরাণের দেবী চণ্ডী। শত্রু দমনের জন্যে দেবী বারবার দেবতাদের আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন। বিনাশ করেছেন শুম্ভ-নিশুম্ভ ,দুর্গমাসুর, মহিষাসুর ও আর দুষ্টদের। দেবী দুর্গা কোন দেবতাকে বধ করেননি। বধ করেছেন দেবতাদের স্বার্থবিরোধী অসুরদের। অসুরদের আবদার যে একেবারে ফেলে দেননি তার প্রমাণও মহিষাসুর। দেবীর কালী রূপের বরে পূজার ফল খাচ্ছে বাঙালির ঘরে ঘরে।
বাঙালি জানে শত্রু দমন হয়ে গেলেই মোক্ষ লাভ হয়ে যায় না। মাঝখান থেকে লাভের গুড় পিপড়া খেয়ে যায়। তাই আমরা বাঙালিরা, দেবতাদের চেয়েও একধাপ এগিয়ে। দেবী দুর্গার কাছে শুধু দুষ্টের বিনাশ কামনা করি না, শত্রুর সম্পত্তিও যাতে আমার হয় সে প্রার্থনাই করি। বাঙালির শত্রু কে ? বাঙালি কবি জয় গোস্বামী বলেন, ‘সন্তাপের কারণ যে হয়, শত্রু সে-ই’। বাঙালির শত্রু এখন বাঙালি। এখন ভাই বলে কেউ নেই। সবাই বিভিষণ। তাই কবি বলেন-‘ জ্ঞাতি বলে কিছু হয় না- আত্মীয়ের বেশি যে আছে, সে প্রতিহিংসা’।
বুকে হাত দিয়ে কতজন বাঙালি বলতে পারবে এবারের পূজায় সর্বজনীন প্রার্থনা করেছি ? কোটিগুয়েক বলতে পারে। আর বাকি সবার শত্রু সেই ঈর্ষা। সুপেয় পানি যেন তার টিউবওয়েলে ওঠে, পাশের বাড়ির আনন্দ যেন বঞ্চিত রয়। তাই পূজা, প্রার্থনা আর উৎসব তিন দিকে মুখ করে আছে যুগে যুগে। দেবী বছরের পর বছর আসছেন। শত্রুর বিনাশ হচ্ছে যথারীতি। কিন্তু দুর্গতি দূর হচ্ছে না। এটা বুদ্ধির সংকীর্ণতা। বন্যা যে পলি মাটি এনে আপনার ক্ষেতের উর্বরতা বাড়াল, সে আপনার সৌভাগ্য নয়। আপন ভাইয়ের ভিটে ভেঙে যে পলি এসেছে তার ক্রন্দন আপনার বক্ষে যেদিন যাবে, সেদিন পূজো সম্পন্ন হবে।
ঘটনা পাল্টেছে। মেয়ে এখন বাপের বাড়ি যেতে চায় না। পূরানো স্মৃতি মনে করে কি লাভ ? এত সুন্দর একটা ছুটি ইউরোপ আমেরিকায় না কাটালে হয় ! নিদেনপক্ষে পাশের দেশ। তাও যদি না পারা যায় দেশের পর্য্টন স্পটগুলোতো আছেই। কলির স্বামীরাও দ্বাপরের কৃষ্ণের মত। রাধা বিনে তিলার্ধ প্রাণ ধরে না। মা,বাপ, ভাই-বোন গোল্লায় যাক। আমি আর আমার স্ত্রী-পুত্রতেই সংসার। মা-বাবা, ভাই-বোন অন্ধ। নিজেরটাই শুধু পেতে চান। নিজেদের কর্ম ভুলে যান। নিজের মেয়ে বাপের বাড়ি নিয়ে পড়ে থাকুক এটাই কাম্য। পরের মেয়ে স্বামী গৃহে খেটে-কুটে মরুক এটাই কলি কালের ধর্ম।
হিমালয়ের মত বাবা এ সমাজে নেই। বছর বছর মেয়ে জামাই নাতি নাতনির এত বড় বহরের সেবা করার বিলাসিতার সুযোগ কই ? সামর্থ্যবান বাবার মেয়ে বাবার বাড়ি আসার সময় পায় না। গরীব পিতার মেয়ে বাবার জন্য পথ চেয়ে থাকে। কিন্তু দরিদ্র পিতা বছরে একবার মেয়ে আনতে পারে না। মেয়ের মা উমার মায়ের মত কাঁদে।
ছবির পেছনেও ছবি থাকে। দুর্গা পূজায় শ্বশুর-শাশুড়ি তাদের লটবহর নিয়ে হাজির হচ্ছেন ধানাঢ্য জামাতার গৃহে। অতএব দুর্গাপূজা শুধুমাত্র মেয়েদের পিত্রালয়ে আসার উৎসব নয়। সর্বজনীন উৎসব।
দুর্গার সমন্বিত পরিবারের প্রতি বাঙালির শ্রদ্ধা আছে। কিন্তু এমন পরিবারে বাঙালির আগ্রহ খুব কম। ফ্ল্যাট নামক ছোট ছোট বাক্সে ভরে গেছে বাংলা। ঝুলন্ত বাবুইদের বাসায় সিংহ, ময়ূর এদের থাকার জায়গা কই ? দুর্গা পরিবার দেখে যেসকল বয়োবৃদ্ধ আফসোস করেন, আগের দিন গেল কই ? সিনিয়র সিটিজেনদের আক্ষেপ শোনে ইয়াং জেনারেশন যাদের গাত্রদাহ হয়, সবার তরে চণ্ডী পাঠ ব্যাতিত আর কোন দরজা খোলা নেই। রক্ষা কর মা চণ্ডী। সকল বাঙালি তথা পৃথিবীর সকল মানুষের মনে নিরপেক্ষ চেতনার উদয় হোক। দুর্গা পরিবারের মত আনন্দময় হোক সকল পরিবার।
“যা দেবী সর্বভূতেষু চেতনেত্যভিধীয়তে”- হে দেবী তুমিই সর্বভূতের চেতনা।
রম্যলেখক