![রবীকাকার প্রিয় বলাই রবীকাকার প্রিয় বলাই](https://www.durjoybangla.com/media/imgAll/2023April/প্রিয়-বলাই-2304220409.jpg)
রবীকাকার প্রিয় বলাই
প্রফুল্লময়ীর মনে শান্তি নেই। বিয়ের পর কোনদিন ছিল না। ছেলেটা হাসপাতালের বিছানায় ছটফট করছে। কানের অসুখের সঙ্গে প্রচন্ড জ্বর, মাথাব্যথা। ডাক্তার কোন চিকিৎসায় ফল পাচ্ছেন না। ছেলের যন্ত্রণা সইতে না পেরে পাশের রুমে রাত কাটান প্রফুল্লুময়ী। ঘরে পাগল স্বামী বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুর। হাসপাতালে মৃত্যুযন্ত্রণায় একমাত্র পুত্র বলেন্দ্রনাথ। সদ্যবিবাহিত ঊনত্রিশ বছরের যুবার এমন করুণ পরিণতি দেখার জন্যেই কি তার নাম রাখা হয়েছিল প্রফুল্লময়ী !
ভোরের আলো ফোটেনি। ছাই রংয়ের প্রলেপ প্রকৃতির গায়ে। প্রফুল্লময়ীর জীবনের রং ধারণ করেছে ধরণী। সুনসান নীরবতা। বলেন্দ্রের রুমের পর্দা সরিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছেন ছেলে জেগেছে কিনা। আজকাল ঘুমের ওষুধও কাবু করতে পারে না বলেন্দ্রকে। মায়ের গন্ধ পেয়ে বলেন্দ্র ডাকল, মা। শান্তভাবে বিছানায় এসে বসলেন প্রফুল্লময়ী।
কিছু বলবে বাবা ?
মায়ের হাত ধরলেন বলেন্দ্র।
তোমার মনে আছে মা, আমি রবিকাকাকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলাম “পথে পথে”
”মনে হয়, হে কবীন্দ্র, তব সাথে যদি
পথে পথে দিন শুধু যেত নিরবধি!”
মা রবিকা আমার খোঁজ নেয়। তুমিতো জান মা, আমি ছোটকালে ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছিলাম। রবিকা আমাকে বদলে দিল। বন্ধু হয়ে, গুরু হয়ে আমার হাতে কলম তুলে দিল। আমার অনেক লেখার ছিল। কিছুই তো হল না মা। কত সম্পাদককে কথা দিয়ে রেখেছি। লেখা শেষ করতে পারবতো ? কথা বল মা।
আমি কি পাগল হয়ে গিয়েছি ? মানুষ তীর্থের জলে স্নান করে পূণ্য লভে, আর আমি পেলাম ব্যাধি। কেন এমন হল মা ?
প্রফুল্লময়ী কোন কথা বলতে পারছেন না। লোনা জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছে বলেন্দ্রের হাতে।
তুই কিছু খাবি, বাবা। সারারাত বোধহয় এসব ভেবে ঘুমাসনি। কিছু হবে না তোর। মহর্ষির আশীর্বাদ আছে তোর উপর। তাঁর দেয়া দায়িত্ব ব্রহ্মস্কুল নির্মাণ না করে তুই যেতে পারিস না। তোর মাকে একলা ফেলে সাহানার মত ছোট্ট মেয়ের সোহাগ কেড়ে তুই যেতে পারবি না। শক্ত হো বাবা। তুই বলেন্দ্র। দেবরাজ ইন্দ্রের বল তোর।
মায়ের কথা শোনে হাসি পায় বলেন্দ্রের। বড় শুষ্ক কঠিন হাসি। মুখের ভেতর দলা পাকায় চিরতা পাতার রসের মত তিতা থুথু। ফেলার সামর্থ্য নেই। গিলে ফেলে।
ইন্দ্রের বল, বলছ মা। যে পাগলের সন্তান। বাঁকা পা নিয়ে যে জন্মেছে। ঠাকুর বাড়ির ছেলেরা স্কুলের গাড়িতে বসে যাকে নিয়ে হাসত। তুমি না তার জন্যে আলাদা গাড়ি করে দিলে।
প্রফুল্লময়ীর চোখের জল বাঁধ ভাঙা জোয়ায়ের মত তেড়ে আসতে চায়, পারে না। চোখের জলেরও স্টক লিমিট থাকে। সরবরাহকারী দুঃখ অনুপাতে জল বরাদ্দ রাখেন। দুঃখ পেয়ে জলের অভাবে কাঁদতে না পারার দুঃখ আর বিশাল। একথা প্রফুল্লময়ীর চেয়ে ঠাকুরবাড়ির কে আর ভাল জানেন।
দেবন্দ্রনাথ ঠাকুরের সকল ছেলেই যখন বিদ্বান, স্ব মহিমায় অধিষ্ঠিত সেখানে চতুর্থ ছেলে বীরেন্দ্রনাথের এ অবস্থা কেন এমন হবে। প্রফুল্লময়ীর চোখের জল মাপার জন্যেই বিধাতা এ খেলা খেলছেন। বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই স্বামী পাগল হয়ে ভর্ত্তি হলেন আলিপুর পাগলা গারদে। তিন বছর চিকিৎসা শেষে ঘরে ফিরলেন। এর মধ্যে মায়ের কোলে এলেন রুগ্ন বলেন্দ্রনাথ। বাঁকা পা। হাঁটা শিখলেন দেরীতে। পা ঘষে চলতেন। ছয় বছর বয়সে ভর্ত্তি হলেন সংস্কৃত কলেজে। শারিরীক অক্ষমতায় কষ্ট পেলেও মা প্রফুল্লময়ী পাশে ছিলেন ছেলের। বার বছর বয়সে স্কুল পরিবর্তন করলেন বলেন্দ্রনাথ। পাশ করলেন এন্ট্রাস।
বলেন্দ্রনাথের দুঃখ কিছু হলেও লাঘব করল ঠাকুর বাড়ির পরিবেশ। পিতৃব্য রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্যদের সান্নিধ্যে সাহিত্য জগতে প্রবেশ ঘটল বলেন্দ্রনাথের।লেখা প্রকাশ হতে লাগল ভারতী, সাধনা পত্রিকায়। অন্যান্য ভ্রাতুষ্পুত্রের তুলনায় অধিক স্নেহ পেলেন রবীকাকার। হয়ে উঠলেন রবীকার সাথী। বাল্মিকী প্রতিভা নাটকে পেলেন অভিনয়ের সুযোগ। লেখালেখির শিক্ষা পেলেন রবীকাকার কাছে। নতুন লেখা হলেই রবীকা কে দেখাতে হত। যতক্ষণ না রবীকার মনমতো লেখা হচ্ছে ততক্ষন ছাড় দিতেন না। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর চোখের মনি ছিলেন বলেন্দ্র। জমিদারীর কাজে শিলাইদহে আসলে সফরসঙ্গী হতেন বলেন্দ্রনাথ। গগনমণ্ডলের লেখা গান “আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে “ উদ্ধার করেন বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর। গগনমণ্ডলকে শিলাইদহের ডাকহরকরা বলতেন বলেন্দ্রনাথ। এই গানের সুরের প্রভাবেই রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন “ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি”। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ব্যবসায়ও হাত লাগিয়েছিলেন বলেন্দ্রনাথ। যদিও ব্যবসায় লক্ষীর দেখা পাননি কাকা ভাতিজা।
বলেন্দ্রনাথ বাল্যে ছিলেন মুখচোরা। স্বভাব কল্পনাতেই তিনি সুখ অনুভব করতেন। মৃত্যুকালে বলেন্দ্রনাথ সুখস্মৃতি অনুভব করতে চাইলেন। মাকে কাছে ডাকলেন। শোধালেন, মা আমার তো ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগ নেই, তাই কোন কাজ নেই। আমার কাছে বস মা। আমাকে ছোটবেলার মত আদর কর। প্রফুল্লময়ী বলেন্দ্রনাথের মাথায় হাত বোলান আর বিলাপ করেন, হে প্রভু কোন অপরাধে আমাকে শাস্তি দিচ্ছ। আমি প্রফুল্লময়ী, না পিরালি বামুন, না ব্রাহ্ম, না নাস্তিক। হে প্রভু, আমি মা। আমার সন্তানকে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা দাও। মা হওয়ার অধিকার যখন দিয়েছ, সন্তানকে স্বান্তনা দেওয়ার ক্ষমতা কেড়ে নিলে কেন ?
স্মৃতিসুখ স্মরণ হচ্ছে না বলেন্দ্রনাথের। মা, আমার কি বিয়ে হয়েছিল ? উচ্ছস্বরে ক্রন্দন আসে প্রফুল্লময়ীর। আঁচল দিয়ে মুখ চাপা দেন। বলেন্দ্রনাথ যাতে টের না পান। শান্তস্বরে বলেন, হ্যাঁ বাবা। তুমি জোঁড়াসাকোর ঠাকুরবাড়ির সন্তান। ধূম ধামের সাথে তুমার বিয়ে হয়েছিল ১৮৯৬ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারী সাহানা ওরফে সুশীলতার সঙ্গে।
মা, আমার বিয়েতে রবীকা এসেছিলেন ?
প্রফুল্লময়ীর কঠিন পরীক্ষা নিচ্ছেন ঈশ্বর। বালিকা বধু সাহানার মুখ দেখতে পারছেন না ঝাপসা চোখে। ভেজা গলায় তবু বলেন, হ্যাঁ বাবা বলে, তুমার রবীকা তুমার বিয়েতে আশীর্বাদও করেছিলেন। সারা বাংলা জানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কত ভালোবাসেন তাঁর ভাইপো বলেন্দ্রনাথ আর স্ত্রী সুশীকে। তাদের বিয়ের উপহার হিসেবে উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত “নদী” কাব্যগ্রন্থ। উৎসর্গপঞ্জীতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন
”পরম স্নেহাস্পদ
শ্রীমাণ বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হস্তে
তাঁহার শুভপরিণয় দিনে
এই গ্রন্থখানি উপহৃত
হইল।
২২ শে মাঘ ১৩০২।”
মা আমার সময় শেষ হয়ে আসছে মা। ক্ষীণ কন্ঠে বলেন্দ্র প্রফুল্লময়ীর কানে বিষময় বাক্যটি ঢাললেন। কোন মা যুবা ছেলের মৃত্যুশয্যায় দাঁড়িয়ে এ কথা শুনতে চায় ? হায় প্রফুল্লময়ী !
মা, আমার মৃত্যুর পর ঠাকুরবাড়ির মানুষ আমার কথা কি মনে রাখবে ? দাদাঠাকুরের স্কুলটার কি গতি হবে ? আমার জন্ম হয়েছিল ? নাকি আমি আবার সুস্থ-সবলরূপে জন্মনেবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। জন্মের প্রাক প্রস্তুতি! হা-হা-হা। তাও মায়ের সামনে। তুমি জাননা মা, আমি আমার অদৃষ্টের কথা জানতাম। ’বোলতা ও মধ্যাহ্ন’ রচনায় তাই আমি লিখি “আমি সন্ধ্যারও নহি, ঊষারও নহি, আমি মধ্যাহ্নের জীব। বৈশাখের প্রখর রবিকিরণে আমার জন্ম-জন্মাবধি রবিকিরণ পান করিয়া আমার এ দেহ গঠিত…….রবিরই মতো আমার কনকবর্ণ, মধ্যাহ্নের মতো আমার সৌন্দর্য্ তীব্র….. মধ্যাহ্ন আর আমি, কেবলমাত্র আলোক।”
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী লিখেছিলেন, বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ রবির আলো, আর বলেন্দ্রনাথ চাঁদের জ্যোৎস্না। রামেন্দ্রসুন্দর অত্যুক্তি করেননি। মাত্র ঊনত্রিশ বছরের নাতিপরিসর জীবনে বলেন্দ্রনাথের মধ্যে প্রৌঢ়ের মনন প্রতিভাত হয়েছিল। ১৮৭০ সালে জন্ম নেওয়া বলেন্দ্রনাথ দুপুর জীবনে বিদায় নিলেন ১৮৯৯ সালে। রবীকাকার সাথে সারা জীবন পথ চলার সাধ তার পূর্ণ হয়নি। শতাধিক সদস্যের পরিবারে এরূপ কোন দ্বিতীয় একলব্য গুরু রবীন্দ্রনাথ পাননি। তবুও আত্মস্মৃতিতে গুরুদেব বলেন্দ্রনাথকে ঠাঁই দেননি !
বলেন্দ্রনাথ ‘ওটাইটিস মিডিয়া’ নামক কর্ণবিষে আক্রান্ত। সীতাকুণ্ডের জলে পূণ্যস্নান করে তার এ স্বর্গযাত্রার আয়োজন। এ অসুখের নিরাময় এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। তাই ডাক্তার হাল ছেড়েছেন।
বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের শরীরের সুখ অনুভূত হচ্ছে। মাকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করছে। চোখ বুজে আসছে তবু ও মাকে জিজ্ঞেস করতে মন চায়, একই পরিবারে অপরাধী, উন্মাদ ও প্রতিভা কেন জন্মায় ?
আরও পড়ুন: আমাদের দুর্গা পরিবার
প্রাবন্ধিক