দুর্গা পরিবারের মাস্ক সমাচার
শারদীয়া দুর্গোৎসব কে যতটা ধর্মীয় উৎসবরূপে পালন করা হয়,তার চেয়ে বেশী উদ্যাপন করা হয় সামাজিক, সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে। রাজা রামচন্দ্র ও রাজা সুরথের লাভ- লোকসানের পূজা হতে বেরিয়ে, ধীরে ধীরে দুর্গা সাধারণ বাঙালী ঘরের মেয়ে হয়েছেন। ব্রাহ্ম, খ্রীষ্টান, মুসলমান-যথাক্রমে রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল মধুসূদন, কাজী নজরুল ইসলাম সকলেই তার আগমনী গান লিখেছেন। আর হিন্দু সাহিত্যিকেরাতো মন প্রাণ সঁপে দিয়েছেন দুর্গা আরাধনায়। দুর্গার পাশাপাশি মহাদেব হয়ে ওঠেছেন বাঙালির ভোলাবালা জামাইবাবু। উমার বুড়ো বর হিসেবে অনেকে কত মজার ছড়া কেটেছে তার ইয়ত্তা নেই। তাই ধর্মীয় ঝুপকাষ্ঠের বাহিরে গিয়ে এ রস নিবন্ধের প্রয়াস।
কে প্রথম মুখোশ আবিষ্কার করেছেন, তা জানা আমার মূখ্য বিষয় নয়। গণেশের মুখের সাইজের কোন মুখোশ পাওয়া যাচ্ছে না। দেবী দুর্গার পরিবারে এটাই এখন সবচেয়ে মাথা গরম হওয়া বিষয়। উমার মনে শান্তি নেই। কার্তিকের কপালে চিন্তার ভাঁজ। ছোট ভাইটি কী তাহলে মুখোশ ছাড়াই মর্ত্যে (মরতে) যাবে ! হাতে সময় কম। অথচ বিজয়া দশমী পর্যন্ত করোনা অসুরের বিদায় হওয়ার তেমন কোন খবর নিশ্চিত করতে পারছে না বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কী করা যায় ?
লক্ষী ও সরস্বতীর এ বিষয়ে তেমন চিন্তা নেই। তারা একটু আগে কৈলাশের সেরা পার্লারে গেছেন। মহালয়ার পর থেকেই তাদের সাজু-গুজু প্রস্তুতি চলে। মায়ের সাথে মামার বাড়ি যাবার একটা ব্যাপার আছে না। অনেক কষ্টে মহিষাসুরের জন্যে একটা মুখোশ পাওয় গেছে। অবশ্য অসুর মহাশয় মাকে বারণ করেছিলেন। “ আমার আবার মুখোশের কী দরকার ? আমিতো অসুর, অসুরের আবার অসুখ-বিসুখ।” মায়ের কড়া ধমক- তুমি আর অসুর নও, আমার পূজার ভাগ তুমি পাও। তুমি এখন দেবতা। তাছাড়া কোভিড-১৯ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ও ছাড়েনি। আর তুমি ? তুমি কী তার চেয়ে বড় অসুর ছিলে ? লজ্জ্বায় মহিষাসুর আর কথা বলেননি। বেখাপ্পা সাইজের মুখোশ পরে বসে আছেন। পশুদের ব্যাপারে ও ভেবেছেন মা। সুদূর ক্যালিফোর্নিয়া থেকে অর্ডার দিয়ে স্পেশাল এম-৯৫ মাস্ক এনেছেন, সিংহ, ইঁদুর, পেঁচা রাজহাস আর ময়ূরের জন্যে।
মহাদেব একটি মুখোশ চেয়েছিলেন। তিনি পাননি। মা বলেছেন, “ তুমিতো জনসমক্ষে থাকো না, পটে থাকো। তুমার ওসব লাগবে না। ছবিতে ভাইরাস সংক্রমিত হয় না। তাছাড়া মুখোশ পরলে কল্কে টানবে কোন পথে ?” গাঁজায় বুঁদ মহাদেব বললেন, ‘ যাক বাঁচা গেল। ওটা আমার সইবে না। এমনি এমনি বলছিলাম। পরে দেখতাম, কেমন লাগে ?’
গুগলে সার্চ করতে করতে অবশেষে গণেশের মাস্ক তৈরির জন্য বাংলাদেশের জে.কে এন্টারপ্রাইজকে কার্যাদেশ দেয়া হল। কার্যাদেশ পেয়েই জে.কে প্ঞ্চাশ ভাগ অগ্রীম চাইল। বাধ্য হয়ে উমা অগ্রীম দিলেন। পূজার মাত্র কয়েকদিন বাকি। কার্যাদেশের মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে। একাত্তর চ্যানেলে সন্ধ্যে সাতটার সংবাদ দেখছিলেন মা। আজকের প্রধান শিরোনাম, প্রতারণার মামলায় জে.কে এন্টারপ্রাইজের মালিক স্ত্রীসহ কারাগারে। আর বাকি রইল কী ? মায়ের সাথে চিটিং। কলিযুগে হচ্ছেটা কী। না! বিকল্প ভাবতে হবে। এবারে গণেশের স্থান মায়ের কোলেই হবে। মা আঁচল দিয়ে গণেশের নাক-মুখ ঢেকে রাখবেন। আর না হয় বিঘœহর্তা গণেশ ভাইরাস বধ করেই মর্ত্যে যাবেন। সবাই বলছে এবার আশি^ন মল মাস তাই মা কার্তিকে আসছেন। আসলে মা জানতেন দু’হাজার বিশ সালে করোনা আসবে। তাই আগে থেকে মা ভ্রমণসূচী পিছিয়ে রেখেছিলেন। তাও সমস্যা দূর হল না। সবাই আগমনী গান শুরু করে দিযেছে । মণ্ডপে মণ্ডপে মূর্তি তৈরি হয়েছে। না গেলে প্রেস্টিজ থাকে, যেতেই হবে।
দোলা, ঘোটক, রথ, হাতি এসব কবে থেকেই বাদ দিয়েছেন মা। এগুলো পঞ্জিকাওয়ালারা ব্যবসার খাতিরে লিখে রেখেছে। এত ভালো ভালো এয়ারলাইনস থাকতে এসবে পোষায় ? বিমানের রিজার্ভেশনের দায়িত্ব গণেশকে দেওয়া হয়েছিল। মুখোশের কারণে তিনি কোনদিকে এগোতে পারছেন না। কোন এয়ারলাইনসই মুখোশ ছাড়া বিমান ভাড়া দিতে চাচ্ছে না। তবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে আলাপ –আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘ যদি পর্যাপ্ত গোমূত্র দিয়ে বিমান স্থান করানো হয়, তবে মুখোশ ছাড়াই ভারতের মাটিতে বিমান অবতরণের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। তবে মমতার এব্যাপারে আপত্তি রযেছে বলে শোনা যাচ্ছে এটা নাকি গুজব, মমতাপন্থীরা বিভিন্ন মিটিঙএ বলছেন, সংখ্যালঘুদের ভোট টানতে মমতা এটা করতেই পারেন না।
মা দেখলেন ব্যাপারটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক হয়ে যাচ্ছে। একটা মুখোশের জন্যে এত রাজনীতি। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমরা দেবতারা চিন্তিত, আর মূর্খ মানব করছে রাজনীতি। করোনার কীট নিয়ে রাজনীতি, করোনার টেস্ট নিয়ে রাজনীতি, ভ্যাকসিন নিয়ে রাজনীতি। পিত্রালয়ের এত দূরাবস্থা। আগেকার দিনে নিজের দূরাবস্থা থেকে শান্তি পেতে , যেতেন বাপের বাড়ি। সব বাঙালি মেয়েরা এ সুযোগে একবার বাপের বাড়ি আসার সুযোগ পেত। অথচ স্বামীর জন্যে চারদিনের বেশি থাকতে পারতেন না। মহাদেব, বুড়ো ভামটা বিজয়া দশমরি দিনেই পদ্মায় ডুবিয়ে, গঙ্গায় চুবিয়ে কৈলাশে নিয়ে যেতেন। এখন দিন পাল্টেছে। সব নারীরা না পারলেও কিছু নারী ক্ষমতার চরম শিখরে রয়েছেন। মহাদেব এখন আমার কথায় উঠেন-বসেন। আর এখন থাকতে পারি না পিত্রালয়ের আত্মকলহ ও দুর্নীতির কারণে। দু’দিনের মাথায় বাপের বাড়ি ছাড়তে ইচ্ছে হয়।
আজ পরিবারের সবাইকে নিয়ে সভা ডেকেছেন উমা। শুধু মহাদেব ধ্যানমগ্ন রয়েছেন। গণেশের মুখোশ পাওয়া যায়নি , একথা কেউ যেন ফেসবুক, টুইটারে শেয়ার না করে। সভার শুরুতেই মা সবাইকে হুঁশিয়ার করে দিলেন। এখন ভাইরসের চেয়েও মারাত্মক, কোন বিষয় ভাইরাল হওয়া। সত্য- মিথ্যা যাচাইয়ের সময় কই ? যার উর্ধ্বাংশ, নি¤œাংশ ভাইরাল হয়েছে, সে-ই বুঝেছে, জ¦ালা কী ? অতএব সাবধান।
বাংলাদেশে গেলে, মেয়েরা যেন সাবধানে থাকে। যা দিনকাল পড়েছে। আগে অসুররা ডিক্লেয়ার দিত। এখন মুখোশে ঢাকা। ভালো মানুষ ভক্তের রূপ ধরে ঘুরে বেড়ায়। চেনার কোন উপায় নেই। চিনলে, আগেই জঞ্জাল সাফ করে দিতাম। সবাইকেতো আর ক্রসফায়ারে দিতে পারি না। দুর্গমকে মেরেছি; কিন্তু এ সময়ের কিশোর-বুড়ো কোন অপরাধী অসুরকে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। সবাই ঘাপটি মেরে আছে। তাই মা ল²ী, মা সর¯^তী নিজেদের সেল্ফ ডিফেন্স কাজে লাগাবে। তুমাদের দিব্যাস্ত্রগুলো একটু চেক করে নিও। পাসওয়ার্ড ভুলে গেলে, মহাভারতের কর্ণের মত অবস্থা হবে। মরণকালে অস্ত্র ব্যবহারের পাসওয়ার্ড ভুলে যাবে। তাছাড়া কৃষ্ণের মত সারথি থাকলে পথ ভুলিয়ে এমন যায়গায় নিয়ে যাবে, ফিরে আসার পথ পাবে না। কেন, তুমরা কর্ণ কথা শোননি।
আর কার্তিককে বলি, গণেশ আমার পাশে সারাক্ষণ ঘুর-ঘুর করে। তাকে নিয়ে চিন্তা নেই। তুমি দেব সেনাপতি। সবসমই বীরত্ব দেখিয়ে বেড়াও। বাংলাদেশে যখন যাবে, আর যাই কর পুলিশের সাথে বাড়াবাড়ি করতে যেও না। পুলিশের নির্দেশনা মেনে চলবে। মর্ত্যরে আইন-শৃক্সখলা এখন আর রয়ে-সয়ে চলে না। আর তুমার ময়ূর কে বলো, কর্কশ্ববে না ডাকতে। ওখানটার পরিবেশবাদীরা অবশ্য ময়ূরসহ অন্যান্য পশুদের নিরাপদ জীবনের জন্যে আন্দোলন করে। কিন্তু বসুন্ধরার শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে ময়ূরের কর্কশ চিৎকার তাদের ঘুম ভাঙালে, পরিবেশবাদীরা ক্ষমা করবে না।
মিটিং শেষ হওয়ার পূর্বেই গণেশ , সভাকষ্ক থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন। কিছুক্ষন পরেই হাতে নিয়ে ফিরলেন একটি মুখোশ। মাকে বললেন, “ দেখ মা, বাবা ভোলানাথ আমার জন্যে এটা বানিয়েছেন। কী সুন্দর দেখতে!” গণেশের পিছনেই ছিলেন মহাদেব। বললেন, গৌরি, ‘ আমি এ বিশে^র সৃষ্টি,পালন ও সংহার কর্তা। আর তুমি গণেশের মুখোশের জন্যে জে. কে এন্টারপ্রাইজকে অর্ডার করেছ। ঘরের মানুষকে চিনলে না।”
উমা গেলেন রেগে, ‘ তুমি কষ্ট করতে গেলে কেন ? ডাক্তার তোমাকে চিন্তা করতে নিষেধ করেছেন, ভুলে গেছ।” কার্তিককে বললেন, যা’তো বাবা প্রেশার মাপার মেশিনটা নিয়ে আয়। পিত্রালয়ে যেতে হবে। এ মুহূর্তে তোর বাপের অসুখ হলে উপায় নেই। তাছাড়া মর্ত্যরে হাসপাতালগুলোর যে অবস্থা, ভর্তি হলেই আসিইউতে ঢুকিযে দেবে। মরার চৌদ্দদিন পরেও ছাড়বে না। আয়- রোজগার আগের মত নেই। মানুষের শ্রদ্ধাবোধ সব লোক দেখানো। আইসিউয়ের বিল ভরার মত পর্যাপ্ত টাকা পাব কোথায় ?
যাক গণেশের মুখোশ পাওয়া গেল। আর চিন্তা নেই। এবারের মহামারি কালের পূজোতে, মহামারি যেন আর না বাড়ে, তাই সবাই ভিড় এড়িয়ে থাকবে। আমার আশে-পাশেই থাকবে। ভালোয়, ভালোয় যেন ফিরতে পারি। জয় মহাদেবের জয়।
রম্যলেখক