
গীতিকার ফজলুর রহমান
অনন্ত অসীম প্রেমময় দুনিয়া। বিঁধির বিধানে ফজলু মিয়ার জীবন গড়া । তাঁর জন্মে পিতা মাতা ছিল আনন্দে মাতোয়ারা। একুশ দিন বয়সে মাতা গেল মারা । দুধের শিশু হল মাতৃ হারা । শৈশব-কৈশোর দুঃখে ভরা । যৌবন বিরহে ঘেরা । পিতা মাতা হারা-ভাই বোন ছাড়া। ছন্ন ছাড়া জীবন ধারা। সংসার বিরাগী হয়ে থাকে পাগল পাড়া।সুর-ছন্দ-শব্দ,তাল-লয়-মাত্রা নিয়ে করে সে খেলা । জীবন সায়াহ্নে অতীত স্মৃতির মায়া। চির বিচ্ছেদের অপেক্ষায় মরণ পাড়ে খাঁড়া । ছন্দে ছন্দে বলছিলাম-নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার সলপ কমলপুর গ্রামে ১৯৪৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর জন্ম নেওয়া মো. ফজলুর রহমানের কথা।
তিনি ঐতিহ্যবাহী কেন্দুয়া ক্লাবের এক চিলে কোঠায় প্রায় চল্লিশ বছর যাবৎ একাকী জীবন যাপন করছেন । আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে রচনা করেন গান । সুরের মূর্ছনায় তাঁর মন রাঙ্গায় । সুরের পাখি হয়ে সুরেলা কন্ঠে নিজেই সুর করেন । নিজের রচিত গানের কথা মালা ছাপার হরফে ছাপিয়ে প্রকাশ করেছেন গ্রন্থাকারে । সুরের পাখি,সংগীত সরোবর,কন্ঠভুবন শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর গীতি কবিতার তিনটি বই । তিনি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের একজন তালিকাভুক্ত গীতিকার । গীতিকার মোঃ ফজলুর রহমান একজন নিভৃতচারী লেখক। বর্তমানে উনাশি (৭৯) বছর বয়সেও লেখালেখি অব্যাহত রেখেছেন । তাঁর গান রচনার মূল বিষয় হামদ/মারফতি, মুর্শিদি, লোকগীতি/পল্লীগীতি, নিগূঢ় তত্ত, বিচ্ছেদ, রাই ধারা, আধুনিক, শাহ্ সুলতান ও দেশাত্মবোধ গান।
জীবনের শেষ মুহুর্তে আরও কিছু হামদ নাত এবং আল্লাহ রাসুলের প্রশংসা ও গুন কীর্তন মূলক রচনা লিখতে পারলেই তাঁর লেখক জীবনের পরিপূর্ণতা হতো। বর্তমানে আরেকটি গ্রন্থ প্রকাশের কাজ চলমান রয়েছে । এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে গীতিকার ফজলুর রহমান বলেন- দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর বর্তমানে কিছুটা সুস্থতা অনুভব করছেন। ডাক্তার আশংকা করেছিলেন যে কোন মুহূর্তে তাঁর জীবনাবসান হতে পারে । ডাক্তার কয়েকমাস পূর্বে-বেঁচে থাকার জন্য একমাস সময় দিয়েছিলেন, আল্লাহর অশেষ রহমতে তিনি এখনো বেঁচে আছেন। জন্মিলে মরিতে হবে এটাই চিরন্তন সত্য। তবু এক জীবনে মানুষ যতটুকু সময় বেঁচে থাকে,সে সময় টুকুতেই ঘটে কত জানা অজানা ঘটনা । কণ্ঠ ভুবনে চির বিরহী গীতিকার মোঃ ফজলুর রহমানের জীবনে রয়েছে চির সত্য করুন ইতিহাস ।
তিনি তাঁর এক গানে লিখেছেন-
জীবনটা যেন এক পুতুল খেলা/
দুঃখ সুখের এক মিলন মেলা/
কখন যে থেমে যাবে এই কলরব/
সন্ধ্যা নামিবে যখন ডুবিবে বেলা ।
নাটকীয় ঘটনাকে হার মানানো তাঁর বাস্তব জীবনের কিছু ঘটনা প্রবাহ;সংক্ষিপ্ত পরিসরে তুলে ধরার চেষ্ঠা করছি মাত্র ।গীতিকার মোঃ ফজলুর রহমানের জন্মের মাত্র ২১ দিনের দিনে মাতৃ বিয়োগের মাধ্যমে তাঁর দুঃখে ভরা জীবনের সূচনা । মায়ের কোল বঞ্চিত শিশু ফজলু মিয়া পিতৃ স্বজনের কাছে লালিত পালিত হতে থাকে । সময় পরিক্রমায় সৎ মা আসে সংসারে । সৎ মায়ের জ্বালা শুরু হয় বেলা-অবেলা । মায়ের আদরের বদলে মিলে কড়া শাসন । দিন দিন সৎ মায়ের চক্ষুশূলে পরিণত হয় ফজলু মিয়া । একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে তার এক পোষ্য ভাই খবর দেয়-আজ যেন ঘরে ভাত না খায় । তাঁর সৎ মা আজ ভাতে বিষ মিশিয়েছে –সে নিজের চোখে দেখেছে ।
অজানা ভয়ে শিউরে উঠে ফজলু মিয়া । তাঁর সারা শরীর কাঁপতে থাকে । তবু সে সাহস করে বাড়িতে যায় । চুপি চুপি গিয়ে তাঁর চাচী ও চাচাতো ভাইকে গোপনে পোষ্য ভাইয়ের বলা ঘটনাটা খুলে বলে । তখন তাঁর চাচী ও চাচাতো ভাই বলে নিজ ঘরে যেতে এবং সৎ মা ভাত দিলে না খেয়ে বসে থাকার পরামর্শ দেয় । তারা তাঁকে নজরে রেখে সময় মত যা করার করবে বলে ফজলু মিয়াকে ঘরে পাঠায় । ঘরে যেতেই সৎ মায়ের দরদ একেবারে উৎলে উঠে । সে কি ! আদর । দ্রুত থালায় করে ভাত তরকারী আনে এবং আদর করে ভাত খেতে বার বার তাগিদ দেয় ।
এমন সময় চাচী ও চাচাতো ভাই ঘরে প্রবেশ করে । ছোট্ট ফজলু মিয়াসহ থালা ভর্তি ভাত তরকারী নিয়ে তারা ঘরের বাহিরে চলে আসে । উঠোনের আঙ্গিনায় বিচরণরত মুরগী ও মুরগী ছানাদের সামনে সেই বিষ মাখা ভাত ছিটিয়ে ফেলে দেয় । মুরগী ও মুরগী ছানারা ভাত খাওয়া শুরু করার পর একে একে ছটফটিয়ে মরতে শুরু করে । পোষ্য ভাইয়ের দেওয়া খবরের কারণে সেদিন চাচী ও চাচাতো ভাইয়ের সহায়তায় ফজলু মিয়া প্রাণে বেঁচে যায় ।
গীতিকার মোঃ ফজলু মিয়া তাঁর এক গানের শেষ অন্তরায় পরম স্রষ্টার উদ্দেশ্যে লিখেছেন-
তুমি যারে দয়া কর
মারিয়াও বাঁচাইতে পারো
তুমি রাখো তুমি মারো
ফজলু মিয়ার কেউ নাইরে ।।
পরবর্তীতে সৎ মা কর্তৃক বিষ খাইয়ে মেরে ফেলার চেষ্ঠার এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাঁর বাবা ও সৎ মায়ের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে । পরে তাঁর বাবা আরেকজন বিধবা মহিলাকে বিয়ে করেন। তিনি খুবই ভালো ছিলেন এবং ফজলু মিয়াকে অনেক আদর করতেন। গীতিকার মোঃ ফজলুর রহমান ১৯৬৬ সালে এস.এস.সি পাশ করেন । পরবর্তীতে দেশে শুরু হয় যুদ্ধ সংগ্রাম । পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে ফজলু মিয়া ভারতে চলে যান । সেখানে থাকা অবস্থায় কিছুদিন পর এলাকা থেকে যাওয়া একজন খবর দেন তাঁর দ্বিতীয় সৎ মা খুবই অসুস্থ । মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে মন আনচান করে । তাই তিঁনি অসুস্থ মাকে দেখতে এলাকায় চলে আসেন । প্রকাশ্যে আসতে না পেরে,মাকে দূর থেকে দেখে চলে গিয়ে এক জায়গা লুকিয়ে থাকে । এই রাতে তার মা মারা যায় । সেখান থেকে এসে মাকে শেষ দেখা দেখেন ।
যুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হওয়ার কেন্দুয়া কলেজ থেকে ৭২ সালে তিনি এইচ এস সি পাশ করেন । পরবর্তীতে ৭৯ সালে আওয়ামীলীগ নেতা তমজিদ উদ্দিন ভূঞাঁ তাঁকে কেন্দুয়া বাজারে পানের আড়ৎ ধারীতে আনেন । পানের আরৎধারী করাকালীন সময়ে তাঁর জীবনে একটি কষ্টের ঘটনা রয়েছে । যা তিনি কখনোই বলতে চান না,আর ভবিষ্যতেও বলবেন না ।
গীতিকার ফজলুর রহমান বলেন-বর্তমান কেন্দুয়া জয়হরি স্প্রাই সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রয়াত শিক্ষক গোলাম মোস্তফা স্যারের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় গান লেখা শুরু করেন। তিনিই তাঁর প্রথম ওস্তাদ। আসাদুল স্যার ছিলেন তিনিও তাঁকে খুবই ভালোবাসতেন। দ্বিতীয় ওস্তাদ আব্দুর রশিদ চৌধুরী। মূলত ৮২ সালেই গান লেখা শুরু করেন। ৪০ বছরের সংগীত লেখার জীবনে অনেক ঘটনার কালের স্বাক্ষী গীতিকার মোঃ ফজলুর রহমান । তিনি কেন্দুয়া ক্লাবে ৭৮ সালে সদস্য হন। তখন মোস্তফা স্যার সকল দায় দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। ম্যানেজার পদে দায়িত্ব পালন করেন। গীতিকার ফজলুর রহমান ঝংকার শিল্পী গোষ্ঠীর সভাপতি,জালাল স্মৃতি পরিষদের সভাপতি। গীতিকার ফজলুর রহমান উপজেলার সলফ কমল পুর গ্রামের মৃত ইন্নুছ আলীর একমাত্র সন্তান।
সংসার বিরাগী প্রসংঙ্গে গীতিকার মোঃ ফজলুর রহমান বলেন-এ আরেক চির রহস্যে ঘেরা চির বিরহ-বিচ্ছেদ অধ্যায় । ১৯৮৪ সালে এক নারীর সাথে কাবিননামা মূলে বিবাহ রেজিস্ট্রি হয়। কিন্ত তাঁর সাথে সংসার জীবনের কোন অধ্যায়ই রচিত হয়নি । পরবর্তীতে আর সংসার করা হয়ে উঠেনি। তখন আরও বেশী গান লেখার দিকে ধাবিত হয়।
তিনি তাঁর আরেক গানে লিখেছেন-
আমি তোমায় মানি বলে/
কতভাবেই দুঃখ দিলে/
তাইতো ফজলু মিয়া বলে/
এই দুঃখটা কোথায় রাখি ।
নববধুঁকে ঘরে তুলে আনার আগেই বিবাহ বিচ্ছেদ ! সে বিষয়ে তিনি বিস্তারিত বলতে নারাজ । হিয়ার ভিতরে গোপন ব্যাথায় ব্যাথিত গীতিকার ফজলুর রহমান আজ জীবন সায়াহ্নে এসে উপনীত হয়েছেন । তাঁর কথায় তিনি প্রকাশ করেছেন-
ডাকি তোমায় হে দয়াময় যদি তোমার দয়া হয়/
কান্ডারী হইও তুমি ফজলু মিয়ার ভাঙ্গা নায়/
এই মিনতি জানাই আল্লাহ ত্বরাইয়া নিও নিদান ।
তিনি মুর্শিদি গানে গানে বলেছেন-
সুজন মাঝিরে আমারে উঠাইও তোমার ময়ুর পঙ্খী নায়/ জীবন নদীর তীরে আছি পাড়ের আশায়।।
এ গীতিকারের বহুল প্রচারিত গানের প্রথম অন্তরাগুলো হল-*মর্জিনারে আইজও তরে ভুলতে পারিনা ।*আঁধার হলো শ্যাম বিহনে হায়রে সাধের বৃন্দাবন/ উতলা হইল আজি কলংকিনী রাধার মন।*শাহ সুলতান বাবা তোমায় সালাম হাজারবার/নাম শুনিয়া পাগল হইয়া অকূলে দিলাম সাঁতার।*কলসী কাঁখে কোন রূপসী ঘাটে আইসাছে/রাঙা ঠোঁটের হাসি আমায় পাগল কইরাছে।*তার সাথে কইরা পিরিতি/ঘটিল আমার দুর্গতি ।*যারে আমি সারা জীবন ভালবাসিলাম/কেমনে ভুলিব আমি বঙ্গবন্ধুর নাম।* তোমরা বাইয়া যাওরে/ষোলো কোটি জনগণের গণতন্ত্রের নাও ।* আপনার রূপ মিশাইয়া ভবে কেন পাঠাইলা/ নামের সাথে যোগ করিলা ইয়া মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহ । এছাড়াও বহুল প্রচারিত আরও বহু গান রয়েছে এ গীতিকারের ।
তাঁর লেখা বহু গান বাংলাদেশ টেলিভিশনে ও রেডিওতে প্রচার হয়েছে। দেশের নামী-দামী শিল্পীর কন্ঠে গাওয়া প্রায় ১৫/১৬ টি অডিও –সিডি বাজারে প্রচার হয়েছে। বাংলাদেশের ফোক পালা গায়ক কদ্দুছ বয়াতীসহ,জহরুল আলম ভূঞাঁ স্বপন, বাউল শিল্পী আ;সালাম সরকার,বাংলাদেশ বেতার-টেলিভিশন শিল্পী প্রদীপ পন্ডিত,দিলবাহার খান,জসিম উদ্দিন,ওলিউল্লাহ,সুসেন সাহা,মুকুল সরকার,আনিসুর রহমান সাগর ও রুবী প্রমুখ শিল্পীবৃন্দ তাঁর গান পরিবেশন করে থাকেন।
গীতিকার ফজলুর রহমান বলেন,গানের মাঝেই আমি আমার জীবনের শেষ দিনগুলি কাটিয়ে দিতে চাই।
আরও পড়ুন: অনবদ্য নাট্যকার ও অভিনেতা রাখাল বিশ্বাস