বিলুপ্ত গ্রামীণ হুমালী খেলা
এক্কা বলরে-লুন্তা হলো রে, দুক্কা বলো রে,লুন্তা চলো রে,
ডাক ডাক বেলি,এসো ভাই খেলি, চোখ পলান্তি সারো কে পালাইতে পারো,রাজার পাছে লোকালে ভেঙ ভাজি খাওবো,অলদি না জলদি,
আমরা বলো কি খাই? মরিচ পোড়া পান্তা খাই,
আমরা সবাই ফেলফেলি, সকাল বিকাল লাই খেলি,
চিত্তরাণী গেল কই? ঐ দেখা যায় তৈ তৈ,
বউ লইয়া পলান্তি,বেঙ ভাজা খাওন্তি,ডুক্কু ডুক্কু আনাইয়া,নৌকা দিয়াম বানাইয়া,যদি নৌকা ডুবে, বিয়া দিয়াম জোড়ে,
ছৈল বইল বরাম্বইল গুট্টুইল।
ইত্যাদি হচ্ছে গ্রামীণ বিভিন্ন খেলার ডাক। এমনই একটি খেলার ডাক হচ্ছে- "মা-চ্ছে-লে-লে-লে-লে- ডিট। এই ডাকের খেলাটিকে "হুমালী খেলা" বলা হতো। এর বিশুদ্ধ নাম যদিও কুস্তি খেলা,কিন্তু এক সময় গ্রামের মানুষ এটিকে হুমালী খেলা বলেই অবহিত করে খেলা পরিবেশনের জন্য থলার আয়োজন করতেন।
গ্রামের মানুষের হাডুডু,দাইড়াবান্দা,বৌছি,গুল্লাছুট,চিত্তরাণী,বাঘবেড়,ষোল্লকইট্ট্যা,গাছখেইল,হাতাবাড়ি,মোরগের লড়াই,কানামাছি,পলাপঞ্জি,হাড়িভাঙ্গা,লাইখেইল,চোর-পুলিশ,ডাঙ্গুলী বা দাড়াগুডি,লাঠিম,মার্বেল,তাস,লুডু ইত্যাদি খেলা ছিল গ্রামীণ সমাজের অনুষঙ্গ। এ সমস্ত খেলা- ধূলা সারা বছরই চলতো গ্রামের বিস্তীর্ণ খোলা মাঠে,গাছতলায়,বড়বাড়ির আঙ্গিনায়,পতিত সমতল ভূমিতে।
গ্রামের সৌখিন- সম্পন্ন মানুষজনই ছিলেন এধরণের খেলা-ধূলার আয়োজক। তারা খেলার জন্য থলা বসাতেন এবং ষাঁড়ের,মহিশের,পাঠা ও ভেড়ার লড়াইয়ের জন্য করতেন আড়ং এর আয়োজন। আড়ংয়ে সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত চলতো পশুতে পশুতে নাড়াই (লড়াই)এর প্রতিযোগীতা। বিজয়ী পশুর মালিককে দেওয়া হতো গবাদিপশু, টেলিভিশন, রেডিও,বাইসাইকেল,ঘড়ি,কাপ,নগদ অর্থ,মেডেল ইত্যাদি। বিজয়ী দলের সাথে ঢোল-বাঁশিসহ বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে বাদ্যকরদল থলা প্রদক্ষিণ করতেন।
এসমস্ত খেলা ছাড়াও মনুষ্যশক্তি পরিক্ষার ভিন্ন রকম একটি খেলা ছিল 'হুমালী'। এই খেলার খেলোয়ারদের নামের পাশে উপাধি দেওয়া হতো 'মাল'।
প্রবীণদের সাথে কথা বলে কয়েকজন মালের নাম জানা গেছে, যেমন-ডেন্ডু মাল,সিরাজ মাল,ফারুক মাল,সোনালী মাল,ওয়াশিদ মাল,জবরিল মাল,আলী মাল,মতি মাল,হাসেম মাল,বাশার মাল,রতন মাল ইত্যাদি।
প্রবীণরা বলেন- হুমালী খেলায় যদি কোন লোক দুই একটি থলায় টানে বিজয়ী হয়েছেন, সে ক্ষেত্রে তার এবং তার পরিবারের লোকেদের সম্মানই বৃদ্ধি পেয়ে গেছে। ফলে তার নামের সাথে গ্রামের নাম ও মাল শব্দ যুক্ত হয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন এলাকার বিশেষ ব্যাক্তি,যুবকদের কাছে হিরো। এমন সুনামধন্য কোন মাল যদি দরিদ্র পরিবারের সন্তান হতেন,তার খাওয়া-পরাসহ অন্যান্য খরচপাতি গ্রামের মানুষ নির্বাহ করতেন। এমন কি কোন কোন ক্ষেত্রে সরকারি ভাবে তাকে সাহায্য সহযোগীতা করা হতো।
'মাল' আসলে কারা হতেন? উঠতি বয়স হতে মধ্য বয়সের শক্তিশালী,সুঠামদেহি,শক্তগড়নের উচ্চতা সম্পন্ন,বলিষ্ট বাহু,উন্নত বক্ষ এরকম মানুষেরাই সাধারণত হুমালী খেলার খেলোয়ার হতেন। তাদের শক্তির পাশাপাশি কৌশলেরও প্রয়োজন হতো। তবে এই খেলোয়ারদের শুরুটা হতো মূলত গ্রামের যুবকদের, বন্ধু বান্ধবদের সাথে হুমালী টানের মাধ্যমে। পরে এক সময় প্রবীণ খেলোয়ারের কাছে গুরুদীক্ষা নিয়ে প্রতিযোগীতার খাতায় নাম লিখিয়ে থলায় বিজয়ী হতে পারলেই নাম-যশ ছড়িয়ে পড়তো।তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হতো না।ডাক পড়তো এক থলা থেকে আর এক থলায়।
খেলার আয়োজক কমিটি ও পদ্ধতি:- যে গ্রামে হুমালী খেলার আয়োজন করা হতো- সেই গ্রামের গণ্যমান্য ব্যাক্তিবর্গ নিয়েই গঠন করা হতো হুমালী প্রতিযোগীতা পরিচালনা কমিটি। প্রয়োজনে আশপাশের গ্রাম থেকেও গণ্যমান্য ব্যাক্তিবর্গকে কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত করা হতো। কমিটির প্রধানের নামে অথবা সাংগঠনিক কোন নাম দেওয়া হলে সেই নামে ছাড়া হতো ফিকচার। এতে যারা টানে অংশ নেবেন-অর্থাৎ মাল হিসেবে খেলবেন তাদের নির্ধারিত একটা ফি দিতে হবে। ফি জমা হলেই জানা যাবে প্রতিযোগীর সংখ্যা। কমিটির নির্ধারিত তারিখ,সময় ও স্থানে খেলার প্রতিযোগী মালেরা তাদের লোকজন নিয়ে এসে সমবেত হন। আয়োজকরা থলাটির চার পাশে খুঁটি গেঁড়ে সূতলিতে রঙিন কাগজ লাগিয়ে বের দিয়ে একটি গেইট রাখেন। চতুরদিকে প্রচুর দর্শক সমাগম হয়। বিচারশালার জন্য কয়েকটি চেয়ার টেবিল থাকে, সেখানে কমিটি ও বিশেষ কোন দাওয়াতি ব্যাক্তি থাকলে তারা ডায়াসে বসেন। খেলা পরিচালনার জন্য থাকেন বিজ্ঞ একজন রেফারি।
খেলোয়ারের পোশাক সাধারণত আন্ডারপ্যান্ট, গেঞ্জি ও ১০/১২হাত লম্বা একটি ধুতিকাপড়। ধুতিটি পাকিয়ে জঙ্গার উপড় দিয়ে কোমড় বের লাগিয়ে মজবুত করে মালকে পরানো হয়। এটিকে 'কাছুপরা'বলে। রেফারির বাঁশী বাজার সাথে সাথে একজন করে মাল 'ডিট ভেঙ্গে' থলায় প্রবেশ করবেন। তিনি লম্বা সুরে বলবেন-"মা-চ্ছে-লে-লে-লে-লে- ডিট।তার লোকেরা বাইরে থেকে বলবে-ডিট।খেলোয়ার বলবেন - আর এক বার, তারা বলবে-ডিট। তার ডিট ভাঙ্গার পর প্রতিপক্ষের কেউ উত্তর না দিলে তিনি বলবেন- আসেন,যে কেউ আমার সাথে টান দিতে পারেন আসুন। তখন প্রতিপক্ষের খেলোয়ার ও তার দল উপরোক্ত ডিট ভেঙ্গে থলায় প্রবেশ করেন। ডিট ভাঙ্গার আওয়াজ বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এ সময় উপস্থিত সকল মানুষ করতালি দিয়ে দুই পক্ষকে উৎসাহ প্রদান করেন। দুই মাল টানের জন্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করলে কমিটি পরিচালককে খেলা শুরু করতে নির্দেশ দেন।
পরিচালক বাঁশিতে ফু দেওয়ার সাথে সাথে দুই মালে ই-য়া-লী- বলে কাছু ধরে টান দেন। পূর্ব সিদ্ধান্ত ও শর্ত মোতাবেক ভাসানো অথবা নীচে ফেলানো।ব্যাস,যিনি ভাসাতে অথবা নিচে ফেলে দিতে পারবেন প্রতিপক্ষকে তিনি হবেন বিজয়ী। চতুর দিকে ছড়িয়ে পড়ে মালের পক্ষে জয়ধ্বনি। উপস্থিত মানুষের করতালি ও জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠে পুরো এলাকা। এ ভাবে খেলায় যে ক'য়জন মাল বিজয়ী হবেন তারা কমিটির কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহনপূর্বক বিজয় মিছিল করে নিজ নিজ গ্রামে ফিরে যান। সেই দিন থেকে তিনি ব্যাপক সম্মানিত মানুষ এবং জনপ্রিয় মাল উপাধিতে ভূষিত হন। মহান স্বাধীনতার দুই এক বছর পরও অর্থাৎ ১৯৭২/৭৩ সন পর্যন্ত পূর্ব ময়মনসিংগের বিভিন্ন গ্রামে মাঝে মধ্যে হুমালী খেলা হতে শোনা গেলেও বর্তমানে এই খেলা একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
চলবে....
আরও পড়ুন: প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বিষয়টি গড়ানোর পর আর আলোচনার প্রয়োজন ছিল না
পর্ব-১৮