
মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জব্বার
ষোড়শ শতাব্দীর পর বাংলা পালা নাট্যে যখন প্রথম বিবেক চরিত্র আননয়ন করা হয় তখন এই বিবেক চরিত্রটি নাট্যকার বা পালাকারগন কাহিনীর মুখপত্র হিসেবে উপস্থাপন করতেন। বিবেক বা গায়ক কাহিনীর বিষয়বস্তু গানের মাধ্যমে আবার সংলাপ প্রক্ষেপনের মাধ্যমেও মঞ্চের সহচরিত্রের উপর কখনো আদেশ কখনো উপদেশ কখনো নীতি কথা উপস্থাপন করে দর্শকদের বাহবা সমর্থ এবং প্রশংসা কুড়াতেন।
সংগীত শিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত আব্দুল জব্বার এ ধারাটি অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বলবত ছিল। উনবিংশ থেকে বিংশ শতাব্দীতে বিবেক চরিত্র হয়ে উঠে আরো গ্রহন যোগ্য আরো প্রয়োজনীয় অনুসংগ। বর্তমানে তা পালার ক্ষেত্রে অপরিহার্য। পালায় বিবেক চরিত্রের গীত ও সংলাপে ভিন্নতা এসেছে , এসেছে সংলাপ প্রক্ষেপনেও। বিবেক চরিত্রটি সাধারণত দরিদ্র , ভিখারী , পাগল প্রকৃতির আবার সাধু সন্ন্যাসী বা অলৌকিক ক্ষমতাধর হিসেবেও উপস্থাপিত হতো। ষাটের দশক থেকে স্বাধীনতার পর বর্তমান বাংলাদেশের যাত্রা অত্যান্ত জনপ্রিয় বিবেক চরিত্রের গায়ক শিল্পী নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের গৌরাঙ্গ আদিত্য।
যাঁর কণ্ঠে সেই “ কাজলা কালো বন্ধু আমার আসবে কবে বলরে কাজলা কিংবা টিরিক্স হবে ফেল গো বাবু টিরিক্স হবে ফেল। আবার যুগের চাকা ঘুরছে উল্টো ভনভন করে ভাই সাচ্চা পথে হাজার বাঁধা বাঁচার উপায় নাই। ” এ ছাড়াও জনপ্রিয় বিবেক শিল্পী কেন্দুয়ার বাদল বাবু , সতীশ বাবু , আব্দুল জব্বার প্রমূখ।
বর্তমানে আছেন নকুল বাবু , মজনু মিয়া , শংকর গায়া , ময়না মিয়াসহ আরো কয়েক জন । এরা সবাই পেশাদার হলেও ব্যাতিক্রম ছিলেন কেন্দুয়ার মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জব্বার। তিনি নাটক পালায় বিবেক চরিত্র ছাড়াও কণ্ঠশিল্পী হিসেবে বিভিন্ন মঞ্চে সঙ্গীত পরিবেশন করে সুনাম ও পুরস্কার অর্জন করেন । অডিও ক্যাসেট ছাড়াও টেলিভিশনে ( বিটিভি ) ভরা নদীর বাঁকে , হিজল তমালসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত সঙ্গীত পরিবেশন করতেন।
আশির দশকে যাত্রা মঞ্চের ব্যাপক চাহিদা সম্পন্ন বিবেক / গায়ক হিসেবে বলা যায় অপরিহার্য ছিলেন কেন্দুয়ার আব্দুল জব্বার ১৯৮৯ ইং সনে কেন্দুয়ায় ঝংকার শিল্পীগোষ্ঠী নামে সঙ্গীত সংগঠন গড়ে তুলতে তাঁর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ঝংকার শিল্পীগোষ্ঠী সংগঠনের নামকরনটিও তিনিই করেছিলেন।
১৯৭৮ ইং সনে কানাই লাল নাথের মা ও ছেলে নাটকে তিনি বিবেক চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেন এবং উক্ত নাটকে আমি তাঁর সঙ্গে প্রথম অনাথ আশ্রমের বালক “ জ্যোতি " চরিত্রে অভিনয় করে প্রসংশিত হই। তারপর বহু বছর বহু মঞ্চে বিভিন্ন চরিত্রে তাঁর সঙ্গে অভিনয় করি। তাঁর উদ্যোগে জুড়াইল প্রাইমারী স্কুলে একটি প্যান্ডেলে ৫ নাইট পালা মঞ্চায়ন হয়।
আমি সে পালাগুলোতেও অভিনয় করি। ১৯৯৭ ইং সনে আমার লেখা মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক পালার নামকরণ একাত্তরের সৈনিক তিনিই করেছিলেন। যে পালাটি অত্যন্ত সুনাম অর্জন করে। এ পালায় তিনি মুক্তিবাহিনীর একটি লিডার চরিত্র রূপদান করেন। কমান্ডিং চরিত্রটি অনবদ্য হয়ে উঠে তাঁর প্যারেট দক্ষতা ও উদ্বুদ্ধ করা গণসঙ্গীতের মাধ্যমে। তাঁর কণ্ঠে কখনো শ্লোগান তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা , বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো সোনার বাংলা স্বাধীন করো ইত্যাদি। আবার সঙ্গীত- জয় বাংলা বাংলার জয় কিংবা এক নদী রক্ত পেরিয়ে বাংলার আকাশে রক্তিম সূর্য আনলে যারা তোমাদের এই ঋণ কোনদিন শোধ হবে না।
এ ছাড়াও তাঁর কণ্ঠে অসংখ্য গান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। মুক্তিযোদ্ধা এই বিবেক শিল্পী ছিলেন সদা হাস্যোজ্জল , সহজ সরল , প্রাণবন্ত একজন মানুষ। তৎকালীন গ্রামীণ নাট্য - পালা আয়োজকদের কাছে তিনি ছিলেন অত্যান্ত উৎসাহদানকারী একজন প্রিয় ব্যক্তি। পালায় বিবেক চরিত্রের এ শিল্পি তার পারিশ্রমিক নিয়ে কখনো দরকষাকষি করেননি। অনেক সময় দেখা গেছে মঞ্চ শেষে আয়োজকরা তার পারিশ্রামিক না দিয়েই চলে গেছেন অথবা সামান্য কিছু দিয়েছেন। এতেও তিনি রাগ করেননি।
১৯৮৮ ইং সনে নান্দাইলের কোন এক এলাকায় আমরা ক'জন শিল্পি একটি নাটকে অভিনয় করতে গিয়েছিলাম। সেখানে আব্দুল জব্বার ভাই ৪ শত টাকা চুক্তিতে বিবেক চরিত্রে গান করতে গেলেন। গান শেষে আয়োকরা কেউ নেই। আমরা চলে আসবো তখন তিনি বললেন কিরে আমার পারিশ্রমিক তো দেয়নি। আমি বললাম তুমি কেমন শিল্পী টাকা না পেয়েই ম্যাকার করলে , গান করলে , রং উঠালে অথচ পারিশ্রমিকের কথা বললে না ? তিনি বললেন , বলেছি এখন না দিলে কি আর করা যাবে। আমরা আয়োজকদের প্রতি ক্ষিপ্ত হলাম।
এক পর্যায়ে একজন লোক এসে চুপি চুপি তার হাতে কিছু একটা দিয়ে চলে গেলেন। জব্বার ভাই বলছেন রাখাল চলো হয়েছে। বললাম দেখি কি হয়েছে ? তিনি হাতের মুঠো খুলে বললেন ১ শ টাকা দিয়েছে চলো চৌরাস্তা গিয়ে সবাই নাস্তা করে নেবো। চলো চলো বলেই ছুটলেন। এই ছিল আমাদের প্রিয় জব্বার ভাই। কিছু পালায় তার পরিবেশিত বিবেক চরিত্র মানুষকে প্রচন্ড ভাবে নাড়া দিতো। যেমন- একটি পয়সা নাটকে পাগলা মিছিল , জীবন নদীর তীরে হারান , গলি থেকে রাজপথে চরণ , মুঘল এ আজমে দিবাকর ঠাকুর , অশ্রু দিয়ে লেখায় রাখহরি , জেল থেকে বলছি গোপিনাথ ইত্যাদি চরিত্র রূপায়ন আজো প্রবীণ দর্শক শ্ৰুতাদের হৃদয়ে গেঁথে রয়েছে। আজো নাট্যাঙ্গনের মানুষদের মনে করিয়ে দেয় নিরঅহংকার সদালাপি শিল্পীসত্ত্বায় সমৃদ্ধ এই মানুষটিকে।
শিল্পী আব্দুল জব্বারের জন্ম ১/১/১৯৫৪ ইং সনে নওপাড়া ইউনিয়নের জুড়াইল গ্রামের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে। তাঁর পিতা সিরাজ আলী বেপারী , মাতা জরিনা আক্তার। এই মহান বিবেক শিল্পী ২০০০ ইং সনের পহেলা ডিসেম্বর মৃত্যু বরণ করেন। তবে তাঁর নামটি যাত্রা নাট্য পালার মানুষদের মনে চির জাগরুক হয়ে আছে এবং থাকবে অনন্তকাল। মহান স্রষ্টার কাছে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি ।
আরও পড়ুন: নেত্রকোণার নামকরনের ইতিহাস ও ঐহিত্য