
নেত্রকোণার নামকরনের ইতিহাস ও ঐহিত্য
বাংলাদেশের উত্তর সীমান্তে, গারো পাহাড়ের পাদদেশে, হাওর, বাওর, জলাশয়, খাল, বিল, নদী নালায় ভরপুর আমাদের এই নেত্রকোণা। নেত্রকোণা একটি গৌরবোজ্জ্বল নাম, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যন্ত যতগুলো সশস্ত্র বিপ্লব ও বিদ্রোহ বাংলাদেশে সংগঠিত হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটিতেই নেত্রকোণার অবদান ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে।
নেত্রকোণার নামাকরণের সাথেও এক সশস্ত্র বিদ্রোহের ইতিহাস জড়িত। বর্তমানে নেত্রকোণা শহর যেখানে অবস্থিত সেখানে কালিগঞ্জ নামে একটি হাট বাজার ছিল। এই কালিগঞ্জ বাজার থেকে সাত-আট মাইল উত্তরে নাঠোরকোনা নামে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করেছিল ব্রিটিশ সরকার। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে এ অঞ্চলে পাগলপন্থী কৃষক বিদ্রোহ দমন করতেই ব্রিটিশরা নাঠোরকোনায় এই পুলিশ ফাঁড়িটি স্থাপন করেছিল।
পাগলপন্থী আন্দোলনের নেতা কৃষক বিদ্রোহের বীর সেনানী নেত্রকোনার পূর্বধলার লেটিরকান্দা গ্রামের বিপ্লবী পাগল টিপু শাহ্কে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়লে টিপু শাহ্ অনুগত বিদ্রোহীরা নাঠোরকোনা পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমন করে তা দখল করে নেয় এবং সমস্ত অস্ত্র লুঠ করে নিয়ে যায়। এ ধরণের বেশ কয়েকটি হামলার পরপরই ব্রিটিশ সরকার নিরাপত্তা জনিত কারণে নাঠোরকোনার পুলিশ ফাঁড়িটি স্থানান্তরিত করে তিন দিক নদী বেষ্টিত কালিগঞ্জ বাজারে নিয়ে আসে। ফাঁড়ি স্থানান্তরিত হলেও নাম নাঠোরকোনাই থেকে যায়। ইংরেজদের উচ্ছারণগত কারণেই নাঠোরকোনা এক পর্যায়ে নেত্রকোনায় রূপান্তরিত হয়ে যায়।
মহুয়া-মলুয়া, সোনাই-মাদব-এর স্মৃতি বিজরিত গীতিকাব্য ও লোক সাহিত্যের তীর্থ ভূমি আমাদের এই নেত্রকোণা। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ও প্রথম চর্যাপদ গীতিকার রচয়িতা বুদ্ধসিদ্ধার্থ আচার্য কাহ্নপা ছিলেন এ অঞ্চলের প্রসিদ্ধ কবি। তারই উত্তরসূরী কবি কঙ্ক, সোলাগাইন এবং অসাধারণ কাব্য প্রতিভার অধিকারী কবি মনসুর বয়াতী। তাদের সৃষ্ট উদার নৈতিক ধর্মীয় পরিবেশ গড়ে উঠা এ অঞ্চল থেকে একে একে রচিত হয় প্রকৃতবাদী ও জীবনবাদী কাহিনী অবলম্বনে কাব্য গাথা, কবিগান, ঘেটু গান, জারি, সারি, ভাটিয়ালী গান।
ড. দীনেশ চন্দ্র সেন রচিত ‘মৈয়মনসিংহ গীতিকা’ বিশ্ব সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যের কাল জয়ী অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত এই গীতিকা সংকলনের উৎস ছিল এই অঞ্চলের মানুষ ও তাদের আচার অনুষ্ঠান।
মৈয়মনসিংহ গীতিকার প্রতি পদে পদে নেত্রকোণার মানুষের মানবিক ঐশ্বর্যের বিষ্ময়কর গুণাবলী প্রতিধ্বনিত হয়েছে। বর্তমান আধুনিক যুগেও নেত্রকোণার শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি এক জীবন্ত বাতিঘর। অনাবিষ্কৃত এ অঞ্চলের মানুষ নিজস্ব স্বকীয়তায় সাহিত্য সংস্কৃতি দিয়ে ভরে তুলেছে এ অঞ্চলের সুখ স্বাচ্ছন্দ ও জীবন বোধকে। কংশ, মগড়া, সুমেশ্বরী ও ধনু নদ-নদীর তীরে গড়ে উঠা বৃত্তে নয়, চিত্তের ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ এক অপরূপ জনবসতি আমাদের এই নেত্রকোণা।
নেত্রকোণা কেবল লোক সাহিত্যের তীর্থ ভূমি নয়, এর রয়েছে সৌর্য বির্যের ইতিহাস। রয়েছে লড়াই, সংগ্রাম আর আন্দোলনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। হযরত শাহ্ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী’র (রহ:) পূণ্যভূমি এই নেত্রকোণা মাটিতেই গড়ে উঠেছে। অত্যাচারী জমিদারদের হুংকার, এই মাটিতেই উত্তোলিত হয়েছে বিপ্লব আর বিদ্রোহের পতাকা, এই মাটিতেই জ্বলসে উঠেছে ঈশা খা’র তরবারী, ব্রিটিশের কামান, আর এই মাটিতেই গর্জে উঠেছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের রাইফেল। শিল্প সাহিত্য সঙ্গীত আর বিদ্রোহ বিপ্লবের বিষ্ময়কর সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে নেত্রকোণার ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
এছাড়াও ৫২ ভাষা আন্দোলন, ৬২ শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ ছয় দফা আন্দোলন ও ৬৯ এর গণ উভ্যুত্থানে রয়েছে নেত্রকোণার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। মহান মুক্তিযুদ্ধে রয়েছে নেত্রকোণার অপরিসীম অবদান। এই অবদানের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের রক্তাক্ত স্বাধীনতার ইতিহাস। সেই সাথে নেত্রকোণার ইতিহাস ও ঐতিহ্য স্বাধীন বাংলাদেশে চির অম্লান হয়ে থাকবে।
লেখকঃ হায়দার জাহান চৌধুরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক