
৫৩ বছর ধরে বাদ্যযন্ত্র ও বাঁশের আসবাবপত্র তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন কেন্দুয়ার আ: সাত্তার
মানুষ যখন উন্নতমান কাঠের, স্টিলের খাট পালং ইত্যাদি আসভাবপত্র ব্যবহার করছেন এসময় বাঁশের খাট, পালং, স্যুকেশ, দরমসহ গৃহস্থালি কাজের বিভিন্ন জিনিসপত্র সনাতনী পদ্ধতিতে তৈরি করে তা বিক্রির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছেন নব্বই বছরের বৃদ্ধ নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার মাসকা ইউনিয়নের চকসাদক কোনাপাড়া গ্রামের আ: সাত্তার।
তিনি তার ছোট্ট একটি ঘরের আঙ্গিনায় প্রতিষ্ঠা করেছেন কাঠ দিয়ে দেশীয় বাদ্যযন্ত্র তৈরির কারখানা। লোহার ফ্রেম তৈরি করে হাতেটানা মেশিন বসিয়ে খুন্দাই কাজের মাধ্যমে সনাতনী পদ্ধতির মাধ্যমে তৈরি করছেন স্বরাজ, দোতারা, একতারা, ডুগডুগি, খুঞ্জুরী, ঢোল, খমক, ঘাইল, বেলাইন ইত্যাদি।
এ ছাড়া বাঁশ-বেতের মাধ্যমে তৈরি করছেন মাছ শিকারের চাঁই (বাইর), পলো, ঝুপড়া, চুপরা, উঁইচ, বৃষ্টি ফেরানোর পাতলা, বিভিন্ন প্রকার ঘুড়ি, বিছানা খাট, পালং, দরম, স্যুকেশ, টেবিল, ৩৫ ফুট লম্বা বাঁশের মই ইত্যাদি।
ক্রেতা তার বাড়িতে এসে এসব জিনিস ক্রয় করে নিয়ে যান। মূল্য নিয়েও সমস্যা হয় না। খুব কম মূল্যেই এসব তৈরি জিনিসপত্র তিনি বিক্রি করে দেন। এর কারণ সম্পর্কে জানা যায়,তিনি অতি দরিদ্র হলেও শুধু ব্যবসার লাভের আশায়ই এ গুলো তৈরি করেন না। এ কাজকে তিনি শিল্প হিসেবে মনে করেন। তাই মাধুরী মিশিয়ে একটু একটু করে এসব জিনিস তৈরি করেন।
যে কারণে নিজে কাঠমিস্ত্রি হিসেবে ৫৩ বছর ধরে মানুষের বহু ঘরবাড়ি নির্মাণ ও ঘর সাজাতে আসভাবপত্র তৈরি করে দিলেও নিজে থাকবার একটি ভাল ঘর নেই তার। অত্যন্ত অর্থকষ্টে একটি মাত্র ভাঙ্গা ঘরে জীবনযাপন করছেন গ্রামপণ্যের অসাধারণ এক হস্তশিল্পী এই কারিগর আ: সাত্তার।
গত শনিবার (১৫ মার্চ) সরেজমিনে তার বাড়িতে গেলে কথা হয় বৃদ্ধ কাঠমিস্তিরি আ: সাত্তারের সঙ্গে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের চকসাদক কোনাপাড়া গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন এই নিভৃতচারী শিল্পী। পিতা মৃত সমর আলী ওরফে লাবু মিয়া, মায়ের নাম নাইবের মা। তারা বহু আগেই মারা গেছেন।
তিনি জানান, একদম লেখাপড়া করেন নি। স্ত্রী মোছা: আবিয়া খাতুনকে নিয়ে সংসারে ৩ ছেলে নজরুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান ও দীন ইসলাম, তাদের স্ত্রীরা এবং নাতি নাতনিদের নিয়ে ২১জনের একটি পরিবার। মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ ভূমিতে তাদের বসবাস।
আ: সাত্তার জানান, প্রথম দিকে সখ করে এসব তৈরি করলেও পরে এটিই পেশা নেশা হয়ে উঠে। ৪০/৪৫ বছর পূর্বে উত্তর মাসকা গ্রামের ঘানি তৈরির কারিগর আ: জব্বারের কাছে কারুকাজের তালিম নেন। তিনিই ওস্তাদ।
এ সমস্ত আসভাবপত্র তৈরিতে কি কি যন্ত্রপাতি লাগে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাদ্যযন্ত্রদ্যযন্ত্র ও আসভাবপত্র তৈরি করতে- কাঠ, বাঁশ, চামড়া, ফিতা ইত্যাদি কিনে আনতে হয়। এসব জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় এখন আর পোষে না। খুব টানাপোড়েনে আছি।
তা ছাড়া বিদ্যুৎ চালিত খুন্দাইল মেশিন নেই। নিজে তৈরি হাতেটানা মেশিন দিয়ে প্রচুর পরিশ্রম করে এসব জিনিস তৈরি করি। এই সমস্ত জিনিস এখন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এগুলো জাদুঘরে স্থান পাওয়ার যোগ্য। তিনি আরও জানান, এই সমস্ত জিনিসপত্র তৈরি করতে দুইজন লোক লাগে। টাকা দিয়ে সহকারি রাখার মত সামর্থ নেই আমার। তাই যখন যাকে পাই তাকে দিয়েই দড়িটানার কাজটা করিয়ে নিই।
এ কাজে সংসার চলে? এমন প্রশ্নের জবাবে এই শিল্পী বলেন, একদম চলে না। ঘরটা ভেঙ্গে পড়ছে মেরামত করতে পারছি না। ছেলেরা মিস্তিরি কাজ করলেও তার আলাদা থাকে। এই শিল্পকর্ম তৈরিতে কি কি সরঞ্জাম- মানে যন্ত্রপাতি লাগে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বেশী কিছু লাগে না। একটি খুন্দাই মেশিন, কুইজবাটাল, রাউন্ডবাটাল, সাফবাটাল, বিলসা, মাথিম, করাত, হাতুড়ি, ফিতা, স্কেল ইত্যাদি।
তিনি বলেন এক সময় বৈঠকি বাউল গান করতাম, এখন আর করি না। আমার তৈরি বাদ্যযন্ত্র দিয়ে শিল্পীরা যখন গানবাজনা করে আমার তখন খুবই আনন্দ হয়। তখন ভুলে যাই পেটে ভাত না থাকার কথা।
তার স্ত্রী মোছা: আবিয়া খাতুন জানান, সারাজীবন মানুষটা কষ্টই করল। থাকার মত একটা ঘর পর্যন্ত নাই। সরকার যদি একটা ঘর, একটা খুন্দাইল মেশিন দিতো বাকি জীবনডা একটু শান্তি পাইতো।
গ্রামের আব্দুল হাই,আব্দুর রহমান, মনিরুল ইসলাম, মহসিন আলম বাবুল বলেন, তিনি একজন অসাধারণ গুণী মানুষ। সারাজীবন তিনি এ কাজ গুলোই করে যাচ্ছেন। তাঁর তৈরি জিনিস মানুষ দেখতে আসে এটা আমাদের গর্ব। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগীতা পেলে শেষ জীবনে একটু শান্তনা নিয়ে যেতে পারতেন।
আরও পড়ুনঃ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা সরকারের নেই: প্রধান উপদেষ্টা
দুর্জয় বাংলা