
কৃষ্ণ কখনো রাজা হতে চাননি। ছবি: পৃথা দেবী
ছাব্বিশে আগস্ট পালিত হলো জন্মাষ্টমী। ভগবান শ্রী কৃষ্ণের জন্মতিথি। কয়েক হাজার বছর ধরে মহাভারতের এই বহরূপী চরিত্রেরআলোচনা হলেও কোথাও শেষ মিলছে না। ভগবানের অন্ত পাওয়া ভার। তোমাকে বধিবে যেগোকুলে বাড়িছে সে। বাক্যটি প্রখ্যাত আলেম দেলোয়ার হোসেন সাঈদী সাহেবের ওয়াজমাহফিলের অডিওতেও আমরা শুনে থাকি। শত্রু সম্পর্কে হুঁশিয়ার করতে আমরা বাক্যটি ব্যবহারকরি। বালক কৃষ্ণ গোকুলে বড় হয়েছিলেন। পরে স্বৈর শাসক কংসকে বধ করেছিলেন কৃষ্ণ। কংস বধপালার এই ডায়ালগটি তাই মিথে পরিণত হয়েছে কালক্রমে। কৃষ্ণও মহাভারতের পাতায় না থেকেআশ্রয় নিয়েছেন ভক্তের মুখে মনে প্রাণে।
কৃষ্ণকে নিয়ে ভাবনার অন্ত নেই। এই ভাবনার সুযোগ কৃষ্ণই করে দিয়েছেন। তিনি গীতায় ঘোষণা দিয়েই রেখেছেন যে আমাকে যেভাবে ডাকবে আমি সেভাবেই তার কাছে ধরা দিব। বন্ধু সখা পুত্র কন্যা ভ্রাতা কোন কিছুতেই তার আপত্তি নেই। সারা বিশ্বে অধীশ্ব হয়েও ফাটাকেষ্ট হতে চাননি কৃষ্ণ। তাই কৃষ্ণের ভক্তরা তাকে ইচ্ছেমত আঁকে। শতনামে ডাকে। তিনি স্বৈরাচারী হয়ে কারো টুটি চেপে ধরেন না। এই হলেন কৃষ্ণ।
অথচ কৃষ্ণচরিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তার চক্রের আঘাতে কাটা পড়েছে কত অসুরের মাথা। নিজে যুদ্ধ করে জিতেছেন কত রাজ্য। মিত্রদের সাহায্য করে জিতিয়েছেন কত রাজ্য। দিয়েছেন বুদ্ধি, বল। নিন্দুকেরা ভেবেছে জয়ের পরে ক্ষমতা ছাড়বেন না কৃষ্ণ। কিন্তু রাজ্যই দখলে নেননি তিনি। কৃষ্ণ কখনো রাজা হতে চাননি।
এক দল অন্ধ কৃষ্ণকে তাদের সম্পদ বানাতে চায়। স্বয়ং ভগবান যেখানে মানুষের সাথে মিশে যেতে চেয়েছেন সেখানে তারা মানুষ আর কৃষ্ণের মাঝে তুলে রেখেছে চীনের প্রাচীর। তারা বলে ভগবানের এসব লীলা সাধারণের দৃষ্টিতে দেখা চলবে না। দিব্য দৃষ্টি লাগবে। কৃষ্ণকে বুঝার সাধ্য সাধারণ মানুষের নেই। তারা কৃষ্ণকে মানুষের ভয়ের কারণ হিসেবে দেখাতে চায়। কঠিন পূজা পদ্ধতির কথা বলে স্বৈরশাসক বানাতে চায় ভগবানকে। স্মরণ করিয়ে দিতে চায় জাগতিক জীবনের সাথে মিলানো যাবে না কৃষ্ণের জীবনকে। এতে পাপ হবে। এরা তারাই যারা জানে না মহাভারতের শিক্ষা মানুষের জন্যে।
মহাভারত অনুসারে ফ্যাসিস্ট রাজাদের অত্যাচারে পৃথিবী একসময় ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। বসুন্ধরা তখন ভয়ে একটি গাভীর রূপ ধরে ব্রহ্মার কাছে করুণা ভিক্ষা চাইলেন। ব্রহ্মা ভগবান বিষ্ণুর সাথে সংযোগ স্থাপন করলেন। ঈশ^র পৃথিবীতে থাকতেন না। ব্রহ্মাÐে শে^তদ্বীপ নামক একটি গ্রহ রয়েছে এবং সেখানে ক্ষীর সমুদ্র নামেআরেকটি জায়গা রয়েছে। ভগবান বিষ্ণু সেখানে থাকতেন। ব্রহ্মার কথা শুনে তিনি পৃথিবেিক রক্ষার জন্যে কৃষ্ণরূপে মহাভারতে অবতীর্ণ হলেন।
রাজশেখর বসু, বঙ্কিমচন্দ্র, দেবীদাস আচার্য প্রমুখ লেখকেরা এক বাক্যে মেনে নিয়েছেন কৃষ্ণ মহাভারতের সবচেয়ে রহস্যময় চরিত্র। তিনি সাধারণ মানুষ নন। তিনি স্বয়ং ভগবান। তবে তিনি সাধারণ মানুষের বেশে পৃথিবীতে এসেছেন মানুষের সমাজে ধর্ম সংস্থাপনের জন্য। স্বৈরাচারীদের দমন করার জন্য। তিনি ঈশ^র এ কথা তার কাছের মানুষকে বুঝাতে হয়েছে। মা বা ভাই বন্ধুকে প্রমাণ দিতে হয়েছে, দেখো আমার বিশ^রূপ আমি ভগবান বিষ্ণু,আমিই শিব, আমিই ব্রহ্মা, আমইি ব্যাস। তোমরা সবাই আমাতেই সমাহিত। দুর্যোধন তাকে কখনো ভগবান হিসেবে মেনে নেননি। কৃষ্ণকে মহাভারতের অনেকেই চতুর ছলনাময় লোক চিহ্নিত করেছেন। মহাভারতের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ভীস্ম কৃষ্ণকে একবার ভগবান মেনেছেন তো আরেকবার সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
ভগবান কৃষ্ণ কিন্তু তার লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন। যে যেভাবে তাকে চেয়েছে তিনি তাকে সেভাবে ধরা দিয়েছেন। তিনি যাকে জগতের শত্রæ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তার বিনাশ করেছেন। যাকে পৃথিবীর জন্য প্রয়োজন মনে করেছেন তার পরম আশ্রয় হয়েছেন । কৃষ্ণ যার সহায় হয়েছেন তার বিনাশ হয়নি,বিজয় হয়েছে ।
তার লক্ষ্য ছিল ধর্ম বিজয় । অর্থশাস্ত্র তিন ধরনের যুদ্ধজয়ের কথা বলেছে- ধর্মবিজয়, লোভবিজয়, অসুর বিজয় । কৃষ্ণ স্বৈরাচারী শাসকদের জয় করে শ্রদ্ধা সমীহ আদায় করে ক্ষান্ত দিয়েছেন ।
স্বৈরশাসককে পরাজিত করে তার স্থলে নিজে ক্ষমতা দখল করেননি । সফল তত্ত¡াবধায়ক সরকারের মত শান্তি স্থাপন করে সৎ লোককে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন । এমন কি স্বৈরশাসকের পুত্রও যদি ধার্মিক, পূণ্যাত্মা হত তবে তাকে তিনি সিংহাসনে বসিয়েছেন। জরাসন্ধকে পরাজিত করে তার ছেলে সহদেবকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন। তাই যারা অনুমান করেন যুদ্ধ জয় করে কৃষ্ণ হয়তো সেসব রাজ্যের নিয়ন্তা হতে চেয়েছিলেন. তা মেনে নেয়া যায় না। তবে যারা বলেন ভগবান কৃষ্ণ হয়তো মিত্রদের জয়কে নিজের জয় হিসেবে ভেবে তৃপ্তি পেয়েছেন তা বহুলাংশে সত্য। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাÐবদের জয়ই তার বড় প্রমাণ।
ধম্মপদ বলেছে- জয় থেকে শত্রæতা আসে। পরাজয়ে মানুষ দুঃখী থাকে। যিনি জয় পরাজয় উভয়কেই ছেড়েছেন। তিনি শান্ত থাকেন। সুখনিদ্রায় শয়ন করেন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জয় পরাজয়ের উর্ধ্বেই ছিলেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষে গান্ধারীর অভিশাপ তিনি মাথা পেতে নিয়েছিলেন। এক পশু শিকারির তীরের আঘাতে তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পর তার বংশ প্রায় ধ্বংস হয়ে যাবে। তার দ্বারকা নগরী নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে সবই তিনি জানতেন। কিন্তু তিনি কোন প্রতিকারের ব্যবস্থা নেননি। কারণ নিয়তির বিধানে একদিন সবকিছুই লয় পাবে। তিনি নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে প্রকৃতি বিরুদ্ধ কাজ করতে চাননি। এর মাধ্যমে তিনি মানুষকে নশ^র জীবনের শিক্ষা দিয়েছেন। আমরা জানি না ভবিষ্যতে কী হবে ? তবুও ভবিষ্যতের সুরক্ষায় কত কিছুই করছি।
ব্যাসদেব এবং অন্যান্য পুরাণ রচয়িতা কৃষ্ণের চরিত্রের মাধ্যমে শশ্মান বৈরাগ্য প্রচার করেননি। বরঞ্চ কৃষ্ণের চরিত্রে মানুষের প্রায় সকল বৈশিষ্টই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। তাই বাংলা সাহিত্যের পুরা মধ্যযুগ শাসন করেছে কৃষ্ণের মোহন বাঁশি।
প্রেম, যুদ্ধ, কুটনীতি, রাজনীতি, ছল-বল-কৌশলের এক অভিনব সংমিশ্রন ভগবান কৃষ্ণ। কৃষ্ণ তার অনুসারীদের কখনো বিষয় ভোগ ছাড়তে বলেননি। শুধু অলঙ্ঘনীয় জাগতিক নিয়মকে শান্ত চিত্তে মেনে নিতে বলেছেন। তাই মহাভারতের স্ত্রীপর্বের এই শ্লোকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ-
সর্বে ক্ষয়ান্তা নিচয়াঃ পতনান্তাঃ সমুচ্ছয়া।
সংযোগা বিপ্রয়োগান্তা মরণান্তং চ জীবিতম।।
এর বাংলা অর্থ হলো- সকল সঞ্চয়ই পরিশেষে ক্ষয় পায়। উন্নতির অন্তে পতন হয়। মিলনের অন্তে বিচ্ছেদ হয়। জীবনের অন্তে মরণ হয়।
হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ মহাভারত পড়ছে, লিখছে কিন্তু এমন লোকের সংখ্যা কয়জন পাওয়া যাবে, যে দৃঢ়ভাবে বিশ^াস করে,তার সঞ্চিত ধন একসময় শেষ হবে। এই যে উন্নতি, এত উন্নতির পরও তার পতন হবে। এত প্রেমিক, এত সমর্থক, এত তোষামোদকারী একসময় এরা কেউ পাশে থাকবে না। মিলন হয়েছে বিধায় এক সময় এদের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে, যে কোন কারণে, হয়তো অকারণে। জীবন অন্তে মরণ হবে, সারা দিন রাত এ কথা জপার পর নিজের মৃত্যু দূরে থাক মানুষ আত্মীয়ের মৃত্যুতেই মূহ্যমান হয়ে পড়ে।
তাই ভগবান কৃষ্ণ শিক্ষা দেন- তিনি সবার কাছে থাকেন, কিন্তু মায়ায় জড়িয়ে পড়েন না। বিপদে ত্রাতা হয়ে দাঁড়ান, কিন্তু লোভের বশীভূত হয়ে সুযোগ খোঁজেন না। ক্ষমতা বলেন, প্রেম বলেন কোন কিছুই ভগবানকে স্থায়ীভাবে আটকাতে পারে না। ক্ষমতা পেয়েই তা যথাসময়ে, যথাব্যক্তিকে বুঝিয়ে দিয়ে অন্যত্র ধর্মস্থাপন করেছেন।
ভগবান কৃষ্ণ পৃথিবীর নিয়ন্তা হতে চাননি বলেই হয়তো পাঁচ হাজার বছর পরেও পৃথিবীর সর্বোত্র কয়েকশ কোটি হিন্দু এবং অন্যান্যরা তাকে ভগবান বলে মানে। জীবন মরণের নিয়ন্তা ভাগ্য বিধাতা বলে জানে।
এই মুহূর্তে যে বা যাহারা জ্ঞানী লোক নিজেদের কৃষ্ণের মত প্রচার করছে। আমি মহান। ক্ষমতা আমি চাই না। আমি শুধু সংস্কার করতে চাই। ধর্ম সংস্থাপনই আমার লক্ষ্য। অথচ কথায় আর কাজে বিপরীত ছবি দেখছে মানুষ। কৃষ্ণ চরিত্র পাঠ করা তাদের অতীব জরুরী। নইলে অচিরেই কংসের তালিকায় স্থান হবে। বাঁশী আর সুদর্শন চক্র থাকলেই যাত্রাপালার স্টার জলসার কৃষ্ণ হওয়া যায় বাসুদেব নয়।
আরও পড়ুন: ময়মনসিংহ বিসিকে কীটনাশক গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, দুই ঘণ্টায় নিয়ন্ত্রণে
প্রাবন্ধিক