মঙ্গলবার ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০ আশ্বিন ১৪৩০

কেন্দুয়ার বাউল সাধক মরমী কবি আব্দুল মজিদ তালুকদার

প্রকাশিত: ২১:৫৭, ৪ আগস্ট ২০২৩

কেন্দুয়ার বাউল সাধক মরমী কবি আব্দুল মজিদ তালুকদার

আব্দুল মজিদ তালুকদার

ভূ-প্রকৃতিগত ভাবে পূর্ব বাংলা নামক নিচু যে এলাকাটি ভাটি অঞ্চল নামে পরিচিত। তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার কেন্দুয়া থানার দলপা ইউনিয়নের ইটাউতা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে আব্দুল মজিদ তালুকদারের জন্ম (১৩০৫ বঙ্গাব্দ)১৮৯৮ খ্রীস্টাব্দের ৫ জানুয়ারি। আব্দুল মজিদ তালুকদারের পিতাঃ হাজী মো:আমছর তালুকদার,মাতা মোছা: মগলের মা।

কৈশোরের দুরন্তপনার সময়ে তিনি মাদ্রাসায় ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন এবং ঐ সময়ে তিনি মসজিদে আযান দিতেন। উনার আযান শুনে যারপরানাই সকলেই মুগ্ধ হতেন। এমনকি মাদ্রাসার প্রধান একদিন আক্ষেপ করে বলেছিলেন,ও যদি গান গাইত তবে সারাজীবন গানের ভুবনে অমর হয়ে থাকত। আবহমান কালের স্রোতে সেই অমর বাণী আব্দুল মজিদ তালুকদারের মরমে গেঁথে প্রেরণার উৎস হয়ে প্রতিফলিত হয় তার সমগ্র জীবন প্রবাহের ঘূর্ণায়মান সঙ্গীত অংগনে।

বাধঁনহারা অনন্ত অসীম প্রেমময় সত্তার অমোঘ আর্কষনে মন কেবলী ছুটে চলে সুরের জগতে। মাদ্রাসা ছেড়ে যোগদেন গ্রাম্য গানের দলে। শুরু হয় নব উদ্যমে রঙ্গীলা ভুবনের নব পথচলা। পুনরায় নেত্রকোনা চন্দ্রনাথ উচ্চ বিদ্যালয় ভর্তি হন। সেখান থেকে এস.এস.সি পাশও করেন তিনি। তখনকার সময়ে মরমী কবি জালাল উদ্দিন খাঁর বাড়িতে নিয়মিত গানের আসর হত সেখানে ছিল তাঁর অবাধ যাতায়াত। গ্রামে অনুষ্ঠিত পালাগানসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও নিয়মিত যাওয়া-আসা করতো।

প্রথম জীবনে আব্দুল মজিদ তালুকদার লেঠুর দলে রাধা-কৃষ্ণের অভিনয় ও গান করেন। সেদিন থেকেই গানের যাত্রা শুরু হয় এবং উদাসী ভাবের জন্ম নেয়। কেননা সেদিনে গাওয়া গান আপামর জনসাধারণকে বিমোহিত করেছিল ,এলাকার কৃষককুল করেছিল ভূয়সী প্রশংসা।

পাটেশ্বরী নদীর কুল কুল স্রোতে ধ্বনিত হয়ে সমবেত জনতার হৃদয় হরণ করে নিয়েছিল। অবশ্য তাঁর পরিবার ছিল গানের ঘোর বিরোধী।কেননা তাঁর পিতা ছিলেন হাজী,মাতা ছিলেন মৌলভী আর এক চাচা যিনি ছিলেন তিনি খুব রাগী ও কঠিন প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। পরিবারের সকল বাঁধা-বিপত্তি পেরিয়ে তিনি গানকে করে নেন আপন সঙ্গী।

নিজের বাড়িতে বৈরী অবস্থার কারণে বিভিন্ন জায়গায় রাতে গান করে,দিনের বেলায় বিভিন্ন জনের বাড়িতে অবস্থান করে বিশ্রাম নিতেন। এভাবেই চলতে থাকে গানের জীবন । পরে দলপা গ্রামের বাউল সাধক গোবরধনের কাছে প্রথম গানের তালিম নেন। দ্বিতীয়ত তিনি মরমী কবি জালাল উদ্দিন খাঁ ও তৃতীয়তে রশিদ উদ্দিন সাহেবের নিকট বাউল গানের তালিম সম্পন্ন করেন। এ শিল্পী ১৬ বছর বয়সে পীরে কামেল কামেল হযরত সৈয়দ আব্দুল্লাহর কাছে বায়াত গ্রহণ করেন। উনাঁর ইন্তেকালের পর পীরে কামেল শাহ্ মুফতি আব্দুল কদ্দুছ হাওলাপুরীর নিকট বায়াত গ্রহণ করে আর্শীবাদ প্রাপ্ত হন।পরবর্তীতে উনাঁর ওফাত গ্রহণের পর আব্দুল মজিদ তালুকদার ৫৫ বছর বয়সে পীরে কামেল মৌলানা হামজায়ে নূরুল হুদা ওরফে শেরে মাস্তানের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে আধ্যাত্বিক বিষয়ে মশগুল হয়ে পড়েন ।

তিনি ১৯৪২ সনে প্রথম অল ইন্ডিয়া রেডিওতে তালিকাভুক্ত হন। তখনকার সময়ে পূর্ব বাংলা ৪ জন শিল্পীর মধ্যে আব্দুল মজিদ তালুকদার ছিলেন ১ জন। স্বাধীনতা উত্তর এবং বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতা যুদ্ধে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সমাবেশে ঐ দেখ কে যায় রে বঙ্গবন্ধু নিশান টাংগাইয়া নাও বাইয়া গানটি করেন। যা শোনে বঙ্গবন্ধু নিজেও এ গানের জন্য শিল্পীকে উচ্চমানের প্রশংসা করেন।

এ শিল্পী দেশের খ্যাতনামা অনেক শিল্পীর সাথে পালা গান করেছেন। আব্দুল মজিদ তালুকদার একতারা বাজিয়ে গান করা শুরু করলেও পরবর্তীতে বেহালা,দু-তারা,হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করেছেন। জানা যায়,শিল্পীকে পল্লী কবি জসিম উদ্দিন সাহেব খুবই স্নেহ করতেন। এ শিল্পী ১৯৪২ সালে ভিক্টোরিয়া সেলিব্রেশনে স্বরচিত গান গেয়ে স্বর্ণ পদক ও প্রশংসা পত্র লাভ করেন। উনার লেখা প্রকাশিত ৭ টি বইয়ের মধ্যে ৩ টি সংরক্ষিত রয়েছে বলে জানা যায়। তন্মধ্যে শেষ নবী উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

আব্দুল মজিদ তালুকদার ছিলেন একাধারে মরমী কবি,গীতিকার,সুরকার,কণ্ঠ শিল্পী। তিনি ১৯৮৮ ইং সনের ৮ ই জুন অসুস্থ অবস্থায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার সময় পথিমধ্যে প্রাণ বায়ূ ত্যাগ করে- চিরতরে চলে যান না ফেরার দেশে।

প্রয়াত আব্দল মজিদ তালুকদার ছিলেন ময়মনসিংহসহ এ অঞ্চলের অহংকার। মৃত্যুর সময় স্ত্রীসহ ৪ ছেলে ৩ মেয়ে রেখে যান। বর্তমানে উপজেলার রামপুর বাজারে শিল্পীর নিজ হাতে গড়া ১৯৮৯ সনে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ক শ্রেণীতে তালিকভুক্ত আব্দুল মজিদ তালুকার শিল্পী গোষ্ঠি সঙ্গীতাঙ্গনে কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন তাঁর পুত্র কন্ঠ শিল্পী আবুল বাশার তালুকদার। লোক শিল্পী ও বাউল কবি আব্দুল মজিদ তালুকদারের জীবন ও সংগীত বিষয়ে মজিদ গীতি সংগ্রহ ও সম্পাদনা করেছেন অধ্যক্ষ মোঃ গোলাম মোস্তফা।

তবে শিল্পীর পুত্র কণ্ঠ শিল্পী আবুল বাশারের তত্বাবধানে গঠিত আব্দুল মজিদ তালুকদার সংগীত বিদ্যালয় ও আব্দুল মজিদ তালুকদার স্মৃতি পাঠাগার বর্তমানে নিজস্ব ভূমি ও অর্থাভাবে আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে রয়েছে।

আরও পড়ুন: কেন্দুয়ার লোক শিল্পী আব্দুল হেলিম বয়াতী: জারি গান ও পূঁথি পাঠ যার জীবনের সাধনা