
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ও বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের (মুজিব বাহিনীর) ভূমিকা সঠিক ভাবে অনুধাবন করতে হলে এর কৌশল এবং আনুসঙ্গিক ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ঘটনার আলোকপাত করতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের মুজিব বাহিনীর মূল রণকৌশল ছিল প্রথাগত যুদ্ধে (Conventional War) না জরিয়ে র্দীঘ মেয়াদী যুদ্ধের অনুকূলে জনযুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি করে সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে কাজ করা। এ জন্যই মুজিব অনুসারী ছাত্র যুবকদের ভারতীয় সেনা বাহিনী বিশেষ করে গেরিলা যুদ্ধের বিশেষজ্ঞ যারা ছিলেন তারা প্রশিক্ষণরত আমরা যারা ছিলাম আমাদের উদ্দেশ্য একটি বিষয় বেশ গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরতেন।
বিষয়টি হলো, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা যারা প্রশিক্ষক হিসাবে ক্যাম্পগুলোতে প্রশিক্ষণ দিতেন তারা প্রায়ই বলতেন বাংলাদেশ মুক্তির লড়াইয়ে গেরিলা যুদ্ধের রণনীতি বা রণকৌশল কি হবে ? বঙ্গবন্ধুর তার ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন।“প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শক্রর মোকবেলা করো এবং ভাতে মারা ও পানিতে মারার ঘোষণা” বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার এই বিষয়বস্তুকে ভারতীয় গেরিলা যুদ্ধের সামরিক বিশেষজ্ঞগণ এনালাইসিস করে মুক্তিযুদ্ধের মুজিব বাহিনীর রণকৌশল নির্ধারণ করেন। যার ফলে আমরা যারা মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্য ছিলাম তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিজ নিজ এলাকায় অবস্থান নিয়ে এলাকার মুজিব অনুসারী ছাত্র-যুবকদের গেরিলা প্রশিক্ষণ দিয়ে গ্রামে গ্রামে গেরিলা ইউনিট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করি। এছাড়া এলাকার মুক্তিকামী মানুষকে মুজিব আর্দশ ও রাজনৈতিক মতাদর্শের মাধ্যমে সৎ, নিষ্ঠাবান, দেশ প্রেমিক, জনযোদ্ধা হিসাবে সংগঠিত করে এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে জনযুদ্ধের মাধ্যমে সার্বিক মুক্তির লড়াইয়ের প্রস্তুতি গ্রহন করি।
এছাড়া শত্রুর গতিবিধি লক্ষ্য রাখা, স্থানীয় দালাল ও শত্রুকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া, মুক্ত অঞ্চল গড়ে তোলা, মুক্ত অঞ্চলে প্রাশাসনিক ব্যবস্থা চালিয়ে যাওয়া, মেডিক্যাল টিম গঠন করা, শত্রু অবস্থানের উপর চোরাগুপ্তা হামলা চালিয়ে নাস্তানাবুদ করা ও তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিনষ্ট করে শত্রুর রসদ সরবরাহে হামলা চালিয়ে ধ্বংস করা, সেই সাথে অব্যাহত হামলা চালিয়ে হানাদার বাহিনীকে ক্যাস্পের মধ্যে অবরুদ্ধ করে রেখে খাদ্য, পানি, ঔষধসহ সামরিক সরঞ্জামাদি সাপ্লাই বন্ধ করে দেওয়াসহ নানামুখী আক্রমণের মাধ্যমে শত্রুসেনাকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলা, এই রণকৌশলকে সামনে রেখেই মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জনগণের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে জনযুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে মুক্ত করা ও দেশের মানুষকে মুক্তি দেওয়াই ছিলো বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত মুজিব বাহিনী রণকৌশল।
শুরু থেকেই মুজিব বাহিনীকে নিয়ে বহু বির্তকের সৃষ্টি হয়েছিল। তাজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্ব গঠিত অস্থায়ী সরকারের অভ্যন্তরিন কোন্দল বা দ্বন্দের ফলে হয়তো মুজিব বাহিনী গঠনে অনুপ্রানিত করেছিল মুজিব অনুসারীদের। এমন একটি ধারনা মুজিবনগর অস্থায়ী সরকার ও আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দর মাঝে বিরাজ করেছিল। তবে মুজিব বাহিনী ছিলো অস্থায়ী সরকার ও বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনী থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও নিয়ন্ত্রনের বাহিরে। মুজিব বাহিনী সৃষ্টি হয়েছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’- এর প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে।
মুজিব বাহিনী গঠন প্রক্রিয়াও ছিলো আলাদা। এ বাহিনীর সম¤œয়কারী ও প্রশিক্ষক ছিলেন ‘র’- এর কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স বিভাগের প্রধান জেনারেল সুজন সিং উভান। তার নেতৃত্ব ও প্রত্যক্ষ সহায়তা মুজিব বাহিনী প্রশিক্ষিত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্যদের ভারতে প্রধান সেনাপতি জেনারেল মানেকশাহ নাম অনুসারে ‘স্যাম’স বয়; নামে’ উল্লেখ করা হতো। জেনারেল উবানের বর্ণনায় জানা যায় ভারতীয় সেনা প্রধান জেনারেল মানেকশাহ নাকি বাংলাদেশে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদকে বলেছিলেন মুজিব বাহিনীকে তিনি গঠন করেছেন, তার বাহিনী হয়ে বিশেষ বিশেষ অভিযানে অংশ নেওয়ার জন্য।ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে মুজিব বাহিনী গঠন ও প্রশিক্ষণ শুরু করেছিলেন। এলিড ফোর্স হিসাবে গঠিত এই বাহিনীকে প্রশিক্ষণ শেষে গোপনীয়তার সঙ্গে অত্যাধুনিক
অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত করে অভিযানে পাঠানো হতো।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা পর্যালোচনা করতে গিয়ে বাংলাদেশ লিভারেশন র্ফোস (মুজিব বাহিনী) ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ ঢাকা স্টেডিয়াম মাঠে মুজিব বাহিনীর অস্ত্র জমা গ্রহন কালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার বক্তৃতার এক পর্যায়ে বলেছিলেন ছাত্রলীগ ও মুজিব বাহিনীর সামরিক ভূমিকাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করলে বাংলার স্বাধীনতার যুদ্ধের পুরো ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ছাত্রলীগের ইতিহাস, স্বাধীনতার ইতিহাস ছাত্রলীগে ইতিহাস।
৭১ সালে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে গঠিত সশস্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন মুজিব বাহিনী (বিএলএফ) এর চার নেতা (Leaders) শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। ষাট দশক থেকে তৎকালীন উপনিবেসিক পাকিস্থানের জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত থেকে রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামীলীগ ও ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় সংগঠিত করে বঙ্গবন্ধুর আর্দশ আনুসারী হিসাবে আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালী জাতিকে স্বাধীনতার দ্বার পৌঁছে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকে মহান মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধে রুপান্তরিত করে স্বাধীনতার সোনালী সূর্যটা কে চিনিয়ে এনেছে।
লেখক: হায়দার জাহান চৌধুরী ,বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক
আরও পড়ুন: অপারেশন সার্চলাইট ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ: হায়দার জাহান চৌধুরী