রোববার ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্জয় বাংলা || Durjoy Bangla

বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে নেত্রকোণা

প্রকাশিত: ০৭:২০, ১৪ মে ২০২৩

বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে নেত্রকোণা

বীর মক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী

বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে নেত্রকোণা একটি গৌরবোজ্জ্বল নাম। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ৭১ এর স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যন্ত যতগুলি সশস্ত্র বিপ্লব ও বিদ্রোহ বাংলাদেশে সংগঠিত হয়েছে তার প্রায় প্রতিটিতে নেত্রকোণার অবদান ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে।

নেত্রকোণা নামকরণের সাথে এক সশস্ত্র বিদ্রোহের ইতিহাস জড়িত। বর্তমান নেত্রকোণা শহর যেখানে অবস্থিত সেখানে কালিগঞ্জ নামে একটি হাট (বাজার) ছিল। এই কালিগঞ্জ থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার উত্তরে নাটোরকোণা গ্রামে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করেছিল বৃটিশ সরকার। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে এ অঞ্চলের পাগলপন্থি সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ দমন করতে নাটোরকোনা গ্রামে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়েছিল।


পাগলপন্থী আন্দোলনের নেতা কৃষক বিদ্রোহের বীর সেনানী পূর্বধলার লেটিরকান্দা গ্রামে টিপুশাহের বৃটিশ সরকার কর্তৃক গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়লে টিপু শাহ এর অনুগত বিদ্রোহীরা এই পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণ করে পুলিশের সব অস্ত্র লুট করে নিয়ে যায়। এ ধরণে বেশ কয়টি হামলার পরেই ইংরেজ সরকার নিরাপত্তা জনিত কারণেই পুলিশ ফাঁড়িটি নাটোরকোণা গ্রাম থেকে কালিগঞ্জ বাজারে স্থানান্তর করে। ফাঁড়িটি স্থানান্তরিত হলেও নাম নাটোরকোণাই থেকে যায়। ইংরেজদের উচ্ছারণ গত কারণেই নাটোরকোণা নেত্রকোণায় রূপান্তরিত হয়।

ঊনবিংশ শতাব্দির শরুতেই ময়মনসিংহ জেলার উত্তরে গারো পাহাড়ের পাদদেশ থেকে শুরু করে ভাটি এলাকাসহ নেত্রকোণা অঞ্চলে বৃটিশদের শাসন ও শোষনের অত্যাচারের জাল বিস্তৃতি লাভ না করলেও সেখানে কয়েক শতাব্দী কাল ব্যাপী সুসং, গৌরিপুর, শেরপুর রাজা ও জমিদারদের নিষ্ঠুর শোষণ নিপীড়ন অব্যাহত ভাবেই চলে আসছিল। এসব জমিদারদের নিষ্ঠুর অত্যাচার ও শোষণের যন্ত্রণায় এ অঞ্চলের কৃষকগণ মুক্তির লক্ষ্যে স্থানীয় উপজাতী সম্প্রদায় গারো হাজংদের নিয়ে সম্মিলিত ভাবে অত্যাচারি জমিদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে।


১৭৬৪ সালে বক্সার যুদ্ধের পর বঙ্গদেশ সম্পূর্ণরূপে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর মাধ্যমে ইংরেজ শাসনের অধীনে চলে যায়। মিরজাফরের জামাতা বাংলার নবাব মির কাসেম দিল্লি সম্রাট শাহ আলম ও অযোদ্ধার নবাবের সম্মিলিত বাহিনী বক্সার যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনীর হাতে শোচনীয় পরাজয় বরণ করে ছত্র ভংগ হয়ে বঙ্গদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এসব সৈন্যরাই পরবর্তীতে ফকির মজনু শাহের নেতৃত্বে বিভিন্ন উপ-দলে বিভক্ত হয়ে বাংলায় ইংরেজ শাসন ও শোষনের বিরুদ্ধে সসস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে। কৌশলগত কারণেই ফকির মজনু শাহ গেরিলা পদ্ধতি অবলম্বন করে রাতের আঁধারে বাংলাদেশে বিভিন্ন স্থানে ইংরেজ স্থাপনাগুলোতে হামলা চালাতে থাকে।

ফকির ও সন্ন্যাসি বেশে ইংরেজদের উপর এ ধরনের হামলাকে ইংরেজ শাসকরা ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ হিসাবে আখ্যায়িত করেন। ফকির মজনু শাহের এক যোগ্য উত্তরসুরী করম শাহ নামের এক ফকির নেতা ১৭৭৫ সালে শেরপুর ও সুসং পরগনায় এসে এ অঞ্চলের স্থানীয় জমিদারদের অত্যাচারে জর্জরিত কৃষক সম্প্রদায়সহ গারো হাজংদেরকে সাম্য মূলক পাগলপন্থী বা বাউল ধর্মে দীক্ষিত করেন।


পাগলপন্থী ধর্মের মুল বিষয়বস্তু ছিল সত্য নিষ্ঠা, সকল মানুষের মধ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব। সকল মানুষ ঈশ্বরের সৃষ্টি, কেউ কারো অধীন নয়, কেউ উঁচু কেউ নিচু এরূপ প্রভেদ করা সঙ্গত নহে। সব মানুষ সমান, সকল মানুষ ভাই ভাই। সাম্যবাদী ফকির করম শাহের পাগলপন্থী মতবাদের অন্যতম প্রধান অনুসারি বিপ্লবী সমাজ সেবক ও সংগ্রামী সাধক কৃষক বিদ্রোহের বীরসেনানী তারই জ্যৈষ্ঠ সন্তান টিপু শাহ পাগল ও তার প্রধান সেনাপতি সন্ন্যাসী নেতা ছফতি সর্দার, তাদের এই সাম্য মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে শ্রেণী ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এ অঞ্চলের নিপীড়িত কৃষক, জমিদারদের অবজ্ঞা আর অবহেলা, শোষণ আর বঞ্চনা, নির্যাতন আর নিষ্পেষিত মানুষের দল পাগলপন্থীদের পতকা তলে একতাবদ্ধ হয়। অত্যাচারিত জমিদারদের বিরুদ্ধে তারা বিদ্রোহের সুচনা করে। আর তারই ফলশ্রুতিতে তৎকালীন সুসং ও শেরপুরের জমিদারদের শোষণ অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম পরিচালিত হয় সেই সংগ্রামে অন্যতম নেতা ছিলেন টিপু ও ছাপাতি সর্দার।

১৮০২ সালে শেষ ভাগে তিনি গারো, হাজং, কোচ, হারি এলাকার নির্যাতিত কৃষকদেরকে সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে টিপু শাহ পাগলের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠাসহ সসস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং টিপু পাগলের নেতৃত্বে রাজ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেন। পাগলপন্থী এই কৃষক বিদ্রোহ দমন করতেই বৃটিশ সরকার এ অঞ্চলের নাটোরকোণায় একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করে বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা চালায়।

পরবর্তীতে সময়ের চাহিদা অনুযায়ী নাটোরকোনা পুলিশ ফাঁড়ি থানা ও মহুকোমায় রূপান্তরিত হয়। সাম্যবাদী সাধক করম শাহের ছেলে টিপু শাহের নেতৃত্বে গড় জরিপায় রাজধানী স্থাপন করে শেরপুর ও সুসং পরগুনায় ছপতি সর্দার এর নেতৃত্বে উপজাতী ও স্থানীয় কৃষকদের মাঝে যে ব্যাপক জাগরণ শুরু হয় সেই জাগরণেই পরবর্তীতে স্থানীয় কৃষক ও গারো হাজং বিদ্রোহে পরিণত হয় যাহা ১৮২৫ সালে ইংরেজ বাহিনীর সাথে গড় জরিকায় এক ভয়াবহ যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধে ময়মনসিংহ সদরের পুলিশ বাহিনীর সহায়তায় রংপুর থেকে আগত ইংরেজ সেনাদল টিপুর রাজধানী গড় জরিকা আক্রমন চালিয়ে টিপুর রাজ্য দখল করে টিপকেু বন্ধী করে ময়মনসিংহ জেলা কারাগারে প্রেরণ করে। পরে ময়মনসিংহ সেসান জজের বিচারে যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয় টিপু শাহের।


১৮৫২ সালে ময়মনসিংহ কারাগারেই টিপুর মৃত্যু হয়। নেত্রকোণার পূর্বধলা উপজেলা লেটিরকান্দা গ্রামে বৃটিশ বিরোধী কৃষক বিদ্রোহরে নেতা পাগলপন্থী মতবাদের অন্যতম প্রধান অনুসারি বিপ্লবী সমাজসেবক শহীদ টিপু শাহেবেকে সমাহিত করা হয়। বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে লেটিরকান্দা গ্রামে টিপু পাগলের সমাদীস্থলে হাজার হাজার ভক্তবৃন্দের আগমন ও তার কবর জেয়ারতসহ বেশ কয়দিন উৎসব মুখর থাকে লেটিরকান্দা গ্রাম।

টিপুর নেতৃত্বে কৃষক বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে উহার প্রচণ্ড আঘাতে ইংরেজ শাসকগণ ভীষণ আতংকিত হয়ে পড়ে। ময়মনসিংহে পূর্বাঞ্চলের গারো হাজং সম্প্রদায়সহ এই কৃষক বিদ্রোহ অস্তমিত করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে ইংরেজ শাসকদেরকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। গারো হাজংদের অসন্তোষ দুর করতে রেভিন্যু বোর্ড কালেক্টর উপজাতী কৃষকদের করের বোঝা আংশিক ভাবে কমানোর চেষ্টা করেও উপজাতী কৃষকদের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ সামান্য মাত্র দূর করতে পারেনি। বরং পরবর্তীতে গারো হাজংদের বিদ্রোহে আয়োজন ও প্রচেষ্টা চলতে থাকে। সুসং জমিদার গারোপাহাড় অঞ্চলে খাজনা আদায়ের জন্য উদ্যত হলে ১৮৩৪ সালে টিপু শাহের শিষ্য সন্ন্যাসী জানুকি গিরি ও দুর্বাজগিরি নেতৃত্বে এসব অঞ্চচলে আবারো বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠে। গারো বাহিনী দলবদ্ধ হয়ে কলমাকান্দা দুর্গাপুর, ধুবাওড়া হালুয়াঘাট এলাকার সমতল ভূমিতে নেমে আসে এবং জমিদারদের কাঁচারি বাড়ী ও ঘাটি গুলিতে সসস্ত্র হামলা চালাতে থাকে। এসব হামলায় স্থানীয় জমিদারদের অনেক পাইক পেয়াদা, বরকন্দাজ ও কর্মচারি নিহত হয়। উপায়ান্তর না দেখে জমিদারগণ ইংরেজ শাসকের শরণাপন্ন হয়। জমিদারদের রক্ষার জন্য ইংরেজ সরকার সেখানে সেনা বাহিনী প্রেরণ করে। সন্ন্যাসি নেতা জানুকিগিরি ও দুর্বাজগিরির নেতৃত্বে গারো বাহিনীর তীর ধনুকসহ দেশীয় অস্ত্র সস্ত্র নিয়ে ইংরেজ বাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়ে, ভয়াভব এই যুদ্ধে গারো বাহিনী পরাজিত হয়ে পাহাড়ি এলাকায় পালিয়ে যায়। বৃটিশ সরকার ক্যাপ্টেন উইলিয়ামকে গারো পাহাড় অঞ্চলে স্থায়ী ভাবে ক্যাম্প করে গারোদের দমন করার জন্য প্রেরণ করে।


১৮৮২ সালে বৃটিশ সরকার যখন গারো পাহাড়ে জরিপ কাজ শুরু করে তখন গারোগণ সরকারি কাজ বন্ধ করে দিয়ে আবার বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ময়মনসিংহের ডেপুটি কমিশনার শতাধিক পুলিশ নিয়ে তাদের দমন করতে গেলে শতশত গারো তীর ধনুক নিয়ে তাদের প্রতিরোধ করে। কমিশনার গারোদেরকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বেশ কিছু গারো পল্লি জ্বালিয়ে দিয়ে গারো বিদ্রোহ দমন করে। এ ঘটনার পর ময়মনসিংহে জেলার উত্তর পূর্বাঞ্চলে শেরপুর পরগনা ও সুসং পরগনায়সহ গারো এলাকায় আর কোন উল্ল্যেখযোগ্য বিদ্রোহের খবর পাওয়া না গেলেও সুসং জমিদারদের টংক প্রথা বিরোধী আন্দোলন পরবর্তী সময়ে বৃটিশ ও জমিদার বিরোধী আন্দোলনে নতুন রূপ নেয়।

টংক আন্দোলন নেত্রকোণা মহুকুমায় গারো পাহাড়ের পাদদেশে সমতল ভূমিতে ময়মনসিংহ জেলার উপজাতি সম্প্রদায়ের অন্যতম হাজং চাষীদেও মাঝে জমিদাদের প্রবর্তিত টংক প্রথার বিরুদ্ধে প্রচন্ড অসন্তোষ দেখা দেয়।

১৮৬৯ সালে গারো এ্যক্ট পাশ করে বৃটিশ সরকার জমিদারদের আয়ের প্রধান উৎস পাহাড়ের মালিকানা ও কর্তৃত্ব সুসং জমিদার নিকট থেকে নিয়ে নেয়। ফলে হাতি খেদা বা হাতি ধরা মাধ্যমে জমিদারদের প্রধান আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যায়। হাতি ধরা এবং হাতি বিক্রি করার আয়ে হাজংদের ছিল বিরাট ভূমিকা। হাতি খেদার মাধ্যমে হাতি ধরা হাজংদেরো এই শ্রমের বিনিময়ে তারা ভোগ করতো চাষের জমি।হাতি খেদা আয় বন্ধ হয়ে যাওয়া জমিদাররা দেশের অন্যান্য এলাকার মতো কৃষকদের জমি উপর খাজনা ধার্য করে। খাজনা আদায় হতো জমির ফসলের মাধ্যমে। জমিতে উৎপন্ন ফসলের একটা অংশ খাজনা হিসাবে চাষিদের নিকট থেকে আদায় করা হতো। এই কর পদ্ধতিই টংক বলে পরিচিত ছিল।

জমির দখল স্বত্ব চাষিদের ছিলনা। এই নতুন জমি ব্যবস্থায় হতাশ হয়ে পড়ে গ্রামের চাষিরা ক্রমে তাদের মাঝে অসন্তোষ দানা বাধতে থাকে। এই অসন্তোষ ক্রমে ব্যাপক আকার ধারন করে। হাজং চাষিদের উপর এই অমানবিক নির্যাতন কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহের দৃষ্টি আর্কষণ করে। কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে জমিদারদের এই প্রথার বিরোদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলে। তার নেতৃত্বে টংক আন্দোলন দূর্বার গতিতে এগিয়ে চলে। দেখতে দেখতে এই আন্দোলন গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। হাজং চাষিরাই ছিল এই আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি। এই আন্দোলন ক্রমে সসস্ত্র আন্দোলনে রূপ নেয়। তারা জমিদারদেরকে টংক (খাজনা) দেওয়া বন্ধ করে দেয় আর সেই সাথে আওয়াজ উঠে “জান দেব তবুও ধান দেব না”।


টংক প্রথা বিরোধী এই সসস্ত্র আন্দোলন ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত চলে। এর মধ্যে দেশ ভাগ হয়ে পাকিস্তান ভারত দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। কিন্তু তারপরও আন্দোলন থেমে নেই। টংক বিরোধী এই আন্দোলন হাজং বিদ্রোহে রূপ নেয় এবং এর চূড়ান্ত পরিনতি ঘঠে ১৯৪৫ সালে হাজং বিদ্রোহের নারী নেত্রী রাসমণিসহ দুইজন পুলিশের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।

নেত্রকোণা মহকুমার দূর্গাপুর থানার বয়রাতলী গ্রাম। এই গ্রামটি ছিল কমিউনিস্টের নেতৃত্বে টংক আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র। এই বয়রাতলী গ্রামে একদিন বেশকিছু পুলিশ হানা দেয় সসস্ত্র বিদ্রোহীদের ধরতে। পুলিশ গ্রামে ঢুকে দেখে গ্রামটি পুরুষশূন্য। গ্রামে নারী পুরুষ সকলেই অন্য একটি গ্রামে চলে যায় গোপন সভা করার জন্য শুধুমাত্র অল্প বয়সী নারী শিশু ছাড়া। কুমুদিনি নামে এক তরুণী বিশেষ কারণে সভায় যেতে পারেনি। পুলিশ গ্রামের প্রতিটি বাড়ীঘর তছনছ করে বিদ্রোহীদের খোঁজে। এক ঘরে তরুণী কুমুদিনিকে দেখে তাকে ধরে টেনেহিছড়ে নিয়ে চলে পুলিশ। কুমুদিনি ভয়ে চিৎকার করতে শুরু করে। এসময় কিছু সংখ্যক বিদ্রোহী সভা থেকে ফিরে আসছিলো গ্রামের দিকে। কুমুদিনির চিৎকার শুনে তারা বল্লম উচিয়ে দ্রুত এগিয়ে এসে পুলিশের সামনে দাড়ায় এদের মধ্যে মধ্যবয়সি এক মহিলা নাম তার রাসমণি। সে বয়রাতলী গ্রামের হাজংদের নেত্রী। কুমুদিনিকে উদ্ধার করতে সেই নাকী বল্লম উচিয়ে পুলিশের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। পুলিশ তখন বিদ্রোহী রাসমণির উপরগুলি চালায়। রাসমণি আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। গুলি তার বুকের ভেতর দিয়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে সে মারা যায়। তাকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখে একজন হাজং বিদ্রোহী পুরুষকর্মী ছুটে এসে পুলিশকে আক্রমন করে, সেও পুলিশের গুলিতে মারা যায়। তখন অন্য হাজংরা যারা অন্যগ্রামে সভা করতে গিয়েছিল তারা গুলির শব্দ শুনে বল্লম উচিয়ে শ্লোগান দিতে দিতে ঘটনা স্থলে চলে আসে। বেগতিক দেখে পুলিশ দ্রুত পালাতে থাকে। এদের মধ্যে দুজন পুলিশ পথ হারিয়ে ফেলে। ক্ষিপ্ত হাজংরা তাদেরকে ঘিরে ফেলে এবং বল্লম দিয়ে আঘাত করতে করতে মেরে ফেলে।

এ খবর ময়মনসিংহ সদরে পৌছলে ময়মনসিংহ সদর থেকে একজন ম্যাজিষ্ট্রেটের নেতৃত্বে এক প্লাটুন ইর্ষ্টান রাইফেলসসহ প্রচুর পুলিশ উপদ্রুত এলাকায় মোতায়েন করে। সেই সাথে হাজং পল্লিগুলোতে শুরু করে পুলিশি অভিযান, চালানো হয় প্রচার অভিযান। এই পুলিশি অভিযানে দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা, লেঙ্গুরাসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় হাজংদেরে সাথে পুলিশের সংর্ঘষ হয়। পরবর্তীতে পাকিস্থান সরকার ১৯৫০ সালে জমিদারী উচ্ছেদ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এই হাজং বিদ্রোহের অবসান ঘঠায়।

ময়মনসিংহ জেলার উত্তরপূর্বাঞ্চলে শেরপুর ও নেত্রকোণা জেলাধীন সুসংপরগনায় শত আন্দোলনের সুতিকাগার। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত এ অঞ্চলের অনেক বীর সন্তানরা আন্দোলণ সংগ্রামে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে এমন অনেক নজীরও যথেষ্ট রয়েছে।


নেত্রকোণার লেটিরকান্দার বীর সেনানী পাগলপন্থি আন্দোলনের অ্যাধ্যাতিক গুরু করিম শাহ ও তার সুযোগ্য পুত্র টিপু শাহর নেতৃত্বে এ অঞ্চলে পরিচালিত হয়েছে ইংরেজ ও জমিদার বিরোধী আন্দোলন। টিপুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে জাতী ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে গড়ে উঠেছিল এক বিশাল জঙ্গী কৃষক বাহিনী তার তেজোদীপ্ত প্রবল বিদ্রোহে ১৮২৪ ও ১৮২৫ সালে কেঁপে উঠেছিল এ অঞ্চলে ইংরেজ শাসনে ভিত। তাই মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অনেক রক্তের বিনিময়ে গড়ে উঠে বাঙ্গালী জাতি তার পূর্বসুরিদের বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামী এই মহান বীরকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা এবং তার বীরত্ব গাঁথা ইতিহাস আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব।

লেখক: সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা। তথ্যসূত্র : রক্তাক্ত অধ্যায়, শতাব্দীর দুই দিগন্ত, বাংলাদেশে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন।

আরও পড়ুন: ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

শীর্ষ সংবাদ:

ঈদ ও নববর্ষে পদ্মা সেতুতে ২১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা টোল আদায়
নতুন বছর অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রেরণা জোগাবে: প্রধানমন্ত্রী
কলমাকান্দায় মোটরসাইকেলের চাকা ফেটে তিনজনের মৃত্যু
র‌্যাব-১৪’র অভিযানে ১৪৫ পিস ইয়াবাসহ এক মাদক ব্যবসায়ী আটক
সবার সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করুন: প্রধানমন্ত্রী
ঈদের ছুটিতে পর্যটক বরণে প্রস্তুত প্রকৃতি কন্যা জাফলং ও নীল নদ লালাখাল
কেন্দুয়ায় তিন দিনব্যাপী ‘জালাল মেলা’ উদযাপনে প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত
ফুলবাড়ীতে ঐতিহ্যবাহী চড়কসহ গ্রামীণ মেলা অনুষ্ঠিত
কেন্দুয়ায় আউশ ধানের বীজ বিতরণ ও মতবিনিময় অনুষ্ঠিত
কলমাকান্দায় দেশীয় অস্ত্রসহ পিতাপুত্র আটক
ঠাকুরগাঁওয়ে গ্রামগঞ্জে জ্বালানি চাহিদা পূরণ করছে গোবরের তৈরি করা লাকড়ি গৃহবধূরা
ফুলবাড়ীতে এসিল্যান্ডের সরকারি মোবাইল ফোন নম্বর ক্লোন চাঁদা দাবি: থানায় জিডি দায়ের
ফুলবাড়ীতে সবজির দাম উর্ধ্বমূখী রাতারাতি দাম বাড়ায় ক্ষুব্ধ ভোক্তা
ধর্মপাশায় সরকারি রাস্তার গাছ কেটে নিলো এক শিক্ষক
সাঈদীর মৃত্যু নিয়ে ফেসবুকে ষ্ট্যাটাস দেয়ায় রামগঞ্জে ছাত্রলীগ নেতা বহিস্কার
বিয়ের দাবিতে প্রেমিকের বাড়ীতে অনশন
মসিকে ১০ কোটি টাকার সড়ক ও ড্রেনের কাজ উদ্বোধন করলেন মেয়র
কলমাকান্দায় নদীর পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু
বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী বাঁশ-বেত শিল্প
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক যতীন সরকারের জন্মদিন উদযাপন
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ যতীন সরকারের ৮৮তম জন্মদিন আজ
১ বিলিয়ন ডলার নিয়ে এমএলএম mtfe বন্ধ
কলমাকান্দায় পুলিশের কাছে ধরা পড়লো তিন মাদক কারবারি
আটপাড়ায় জিপিএ-৫ প্রাপ্ত ১০৩ জন কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা
নকলায় ফাঁসিতে ঝুলে নেশাগ্রস্থ কিশোরের আত্মহত্যা
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ নুরুল ইসলামের রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস
কলমাকান্দায় আগুনে পুড়ে ২১ দোকানঘর ছাই

Notice: Undefined variable: sAddThis in /home/durjoyba/public_html/details.php on line 809