
লেখা ও লেখক: এই সময়
আচ্ছা আপনি-যে লিখছেন, আপনার অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড আছে! আমার নাই। আমি চুপ করে থাকতে বাধ্য। ভয় পাই। হাত-পা ভেঙে দিলে তো তবু হয়তো একটা সাহায্য-তহবিলের গায়ের স্ট্যাম্প-সাইজ ছবি হব! মরে পড়ে রইলে? স্বামী প্রাণ হারালে স্ত্রীর পক্ষে বিধবা হওয়া ছাড়া গত্যন্তর কী! কাজেই গদ্যকার্টুনে আর সেই ধার নেই। কোনো ভাসুরের নাম নেই না। শুধু নিরীহ জোক্সগুলো আবার বলি! লোকে এত কিছু বোঝে আর এ ফাঁকিটা বোঝে না!
যেমন এ লেখাটা! সবার গা বাঁচিয়ে কেমন নিজের মাথা-বাঁচানোর চেষ্টা! অন্যদের আঘাত না করে নিজেকে নিয়েই রসিকতার চেষ্টা! তবে লেখালেখিতে যে একদম কাজ হয় না, তা হয়তো নয়। এই কথাগুলো আনিসুল হকের। বর্তমানের সময়ের শক্তিমান জনপ্রিয় লেখক। আজ থেকে চব্বিশ বছর আগে একত্রিশ মে দুই হাজার এক সালে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছিলেন গদ্য কার্টুন- এ বড় রঙ্গ জাদু, এ বড় রঙ্গ। সত্যিই আনিসুল হক যত পরিণত হয়েছেন তত তার লেখার ধার কমে এসেছে। যেসব লেখায় মাথা কাটা যাবার ভয় আছে সেগুলোর মধ্যে আনিসুল হক আর নেই। আর যাই হোক জীবন নিয়ে রঙ্গ করা চলে এটা তিনি বুঝতে বাধ্য হয়েছেন। আমরা তারপরও বাংলায় সেরা লেখা চাই বাংলাদেশে।
লেখক কেন লিখেন ? এর উত্তর অনেকেই অনেকভাবে দিয়েছেন। এনিম্যাল ফার্ম খ্যাত লেখক জর্জ অরওয়েল মনে করেন, সব লেখকই অহংকারী, স্বার্থপর, অলস, এবং তাদের লেখার গভীরের উদ্দেশ্য রহস্যাবৃত। বই লেখা একটি ভয়ংকর, শ্রমসাধ্য লড়াই। এই লড়াইকে তুলনা করা যেতে পারে কোন যন্ত্রণাময় অসুস্থতার সাথে কোন রোগীর দীর্ঘ জীবন যুদ্ধের । কেউ এ কাজে হাত দেবে না যদি না তাকে একটি দৈত্য শক্তি তাড়া না করে। আর এই ডিমনিক শক্তিকে প্রতিহত করা বা ঠিকমত বোঝা যায় না।
রহস্যাবৃত উদ্দেশ্য হলেও মহৎ লেখক তার লেখা পাঠকের কাছে স্পষ্ট করেন। আমি এই কারণে লিখি। আমি এই বিষয়টা বলতে চাই। বলতে না পারলেও না পারার কারণ তিনি বলেন যে তার ঘাঢ়ে তিনটি মাথা নেই। কিন্ত এই সময়ে লেখালেখির নামে যারা আবার হায়ারোগ্লিফিকের আদলে নতুন চর্যাপদ লিখছেন, তারা কী চান ? তাদের লেখার উদ্দেশ্য কী ? শুধুই ডিগ্রী আর পুরষ্কার !
যে সমাজের ছাল বাকল কিছুই আর অবশিষ্ট নেই সেই সমাজের অনাচার নিয়ে লেখা বই কোন প্রতিষ্ঠিত লেখক লিখছেন। বেশ কয়েকজন তরুণ সত্য লেখার দায়ে মাথা হারিয়েছেন। বর্তমানে স্বকৃত নোমানের মত দু একজন লেখক মাথা তুলছেন না যে তা নয়। তবে গর্দানে মাথা থাকতে থাকতে খ্যাতি এসে গেলে আনিসুল হকের মত লেখার ধার কমে যাবে না তো। ভাসুরদের ভয়ে লেখকরা একসময় স্রেফ গল্প লেখকে পরিণত হচ্ছেন। ভূত প্রেতের গল্প লিখছেন। সবিতার নামে কবিতা লিখেছেন। ন্যূনতম লজ্জার চিন্তা নেই আজ বাংলাদেশের লেখকের। কারণ সৈয়দ মুজতবা আলীর তোতাকাহিনীর শিক্ষা এদের কারোরই নেই। মরার আগে মোক্ষলাভ এদের দিয়ে হবার নয়।
প্রশ্ন হচ্ছে লেখকরা এরকম করছেন কেন? লিখতে গিয়ে ভয় পাচ্ছেন কেন? সত্য বলার দায়ে সেই সভ্যতার আদিকাল থেকেই মানুষ শাস্তি পেয়ে এসেছে। বাঙালির বেলায়ও তা ঘটেছে। কিন্ত কখনোই এত বন্ধ্যা সময় আসেনি। বাঙালি বাংলাদেশের লেখক তাহলে কি হাতির মত হয়ে পড়েছেন। ভুলে গেছেন নিজেদের শক্তিকে। হয়ে পড়েছেন চেয়ারের দাস। সামান্য শিকলে আটকা পড়েছেন নিজের শক্তি ভুলে। একটা কোথাও কেউ ভাসুরের নাম মুখে নিচ্ছেন না। অথচ পুরা সমাজটাই ভাসুররূপী অসুররা দখল করে রেখেছে। সমাজের অসংগতি আমাদের লেখকদের কাছে সড়ক দুর্ঘটনার মতই। এ যেন নিয়তি। সড়ক আছে দুর্ঘটনা ঘটবে। মানুষ মরবে স্বাভাবিক বিষয়। আমিতো মরিনি। আমার কেউ তো মরেনি। আমি কেন কথা বলব ? সমাজ আছে। অপরাধ অসংগতি এসব থাকবে। আমি লেখক। আমি কবি। আমি গীতিকার। রাই কেন রাধার কুঞ্জে আসে না তাই দেখাই আমার কাজ। আমি ওসব মাথা খোয়ানোর লেখায় নেই।
এই সময়ের লেখক, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, কবি, কলামিস্ট সবার চরণে প্রণতি জানাই, কদমবুচি করি। আপনার লেখা বুঝার সাধ্য আমজনতার নেই। আপনরাই পত্র পত্রিকায়, আচার অনুষ্ঠানে, যোগাযোগমাধ্যমে প্রায় উদাম হয়েই বলছেন- আমার লেখা, আমি লিখব আমি সেই লেখা লিখব যে লেখা সমাজের উচ্চস্থরের মানুষ বাহবা দেয়। সংখ্যালঘু উন্নত শ্রেণী আমার লেখা তাদের দামী প্রকাশনা প্রচারণায় রাখবে। জীবনানন্দের মত ঘাস লতা পাতায় তোমরা থাকো। এক নজরুলের কবিতাই হজম করতে পারেনি বাঙালিরা। তাই এখনো উপেক্ষিত এই বিদ্রোহী লেখক।শিক্ষিত বাঙালি কোলকাতায় জন্মকর্ম। জানে না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আসলে ঠিক কী করতেন? আর আমি লিখব সমাজ পরিবর্তনের লেখা। আমি আমার ভাগ্য পরিবর্তনের লেখা লিখব। আজকাল সরস্বতীর প্রতিনিধি শিক্ষক এভাবেই নির্বাচিত হোন। আমি সেসব শিক্ষকের ছাত্র। আমাকে লেখা শেখাতে আসবেন না।
লেখক কেন সমাজের সমস্যা, সম্ভাবনা নিয়ে লিখবেন? কী লাভ তার? কে চায় লেখক এসব করুক? কেউ চায় বলে মনে হয় না। কারণ সমাজ এমন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, প্রত্যেক লোকই কোন না কোনভাবে অপকর্মের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। অপকর্ম হয়ে পড়েছে মূল কর্ম। বৈতল গ্রামীণ বিড়াল যেমন মল ত্যাগ করার মাটি দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করে। আজকের লেখকরা তাই করছেন। বাসায় বসে নিয়ম নীতি মেনেই ছবি আঁকছেন। আর প্রদর্শনের সময় দেখছেন আরে এ তো আমারই ছবি। এত কুৎসিত স্বরূপ দেখাই কী করে? তখন ঘষে মেঝে লেখক, শিল্পী তার শিল্পকর্মকে এমন এক রূপ দেন ,যাহা সর্বজনীন হোমিওপ্যাথ। কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। এসব লেখালেখি আর শিল্প তাই বাংলাদেশের মননচর্চার বন্ধ্যাযুগের সাক্ষী হয়ে থাকবে। অনেক জার্নালিস্ট একসময় লেখক ছিলেন অথবা তাও বলা যায় কোন কোন জার্নালিস্ট তার লেখালেখি দ্বারা খ্যাতিমান লেখক হয়েছিলেন। এ যুগের লেখকরা না জার্নালিস্ট না লেখক। তারা সৈয়দ মুজতবা আলীর পঞ্চতন্ত্র মুখস্ত করে বসে আছেন।
জার্নালিস্ট কে?
কেন, যিনি পত্রিকায় লেখালেখি করেন ? হলো না। জার্নালিস্ট সেই ব্যক্তি যিনি লিখেন না। যিনি ক্ষমতাবানের কাছ থেকে পাওয়া অর্থের বিনিময়ে লেখা থেকে বিরত থাকেন, অর্থ্যাৎ লিখেন না। সংবাদপত্রের সেই জার্নালিস্ট তত বিখ্যাত হয়েছেন যিনি না লিখে সমাজের ক্ষমতাবানের অপকর্মের সঙ্গী হয়েছেন। লেখক হয়ে সমাজে মাথা বাঁচিয়ে চলা খুব কঠিন। চরম প্রগতিশীল দেশগুলোতেই লেখকের বেঁচে থাকা যেখানে কঠিন সেখানে আমাদের মত দেশে গুটিকয়েক লোক সত্যিকারের লেখক পরিচয়ে লিখছেন, বেঁচে আছেন এটা অনেক সৌভাগ্য। এ যেন রোদে মেঘে বৃষ্টি আর শিয়ালের বিয়ে হওয়ার মত ঘটনা।
লেখক আকাশ থেকে পড়েন না। পৃথিবীর অনেক মহামানব শিশুরূপে জন্মালেও তার অনুসারীরা তা মানবে না। কিন্ত রবীন্দ্রনাথ বা সেক্সপিয়ারের অন্ধ ভক্ত ও মানবে না তারা জন্ম থেকেই লেখক। সমাজ লেখকের সৃষ্টি করে। সমাজই লেখকের পথ সহজ করে আবার সমাজই লেখকের পথ রুদ্ধ করে। প্রশ্ন হচ্ছে এমন মানব সমাজ কবে সৃজন হবে ভেবে আমরা বসে রইব। নাকি খেলায় মন দিব টুয়েন্টি টুয়েন্টি।
বাজারে দুধ সস্তা গাই পোষার কী প্রয়োজন। তিশা মুস্তাক, হিরো আলম ,সাবরিনা এরা লিখছে। মানুষ পড়ছে। চাইলে এআই ইচ্ছামতো গল্প, রচনা লিখে দিচ্ছে। লেখকের আর কী প্রয়োজন? তাই মিডিয়ার আর কোন দায় নেই লেখক সৃষ্টিতে। লেখা, ঐ একটা হলেই হলো। মানুষ এখন লাইভ চায়। তাই লেখা, লেখক, লেখকের প্রজ্ঞা ,চিন্তা অনুশীলন এগুলো ফালতু বিষয়ে পরিণত হয়েছে।