শিক্ষক মো. মাহমুদুল আলম
দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি ইউটিউব দেখে নানা গুন সমৃদ্ধ ড্রাগন ফল বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে সফলতার মুখ দেখছেন কলেজ শিক্ষক মো. মাহমুদুল আলম। রোগ-বালাই কম হওয়ার পাশাপাশি চাষ পদ্বতি সহজ হওয়ায় এবং বাজারে ভালো চাহিদা থাকায় তার বাগানটি দেখে বিদেশি এ ফল চাষে এরইমধ্যে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন আশপাশের চাষিরা।
মাহমুদুল আলম উপজেলার এলুয়াড়ী ইউনিয়নের বারাইহাট চেয়ারম্যান পাড়ার বাসিন্দা এবং ফুলবাড়ী টেকনিক্যাল এণ্ড বিএম ইনস্টিটিউটের প্রভাষক হিসেবে কর্মরত।
সরেজমিতে এলুয়াড়ী ইউনিয়নের বারাইহাট চেয়ারম্যান পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, ২৮ শতক জমিতে একটি সুন্দর পরিবেশে ড্রাগন বাগান করেছেন মাহমুদুল আলম। প্রতিটি পিলার বেয়ে উপরে রেলপাটে উঠেছে ড্রাগন গাছগুলো। বর্তমানে তার বাগানের প্রতিটি গাছে শোভা পাচ্ছে হলুদ ও লাল রংয়ের ড্রাগন ফল। সেগুলো নিজেই পরিচর্যা করছেন কলেজ শিক্ষক মাহমুদুল আলম। পাশাপাশি কাজ করছেন গ্রামের প্রায় ৮ থেকে ১০ জন নারী। তারাদের কাজ বাগানের আগাছা পরিষ্কার করা।
জানা যায়, মাহমুদুল আলম দীর্ঘদিন থেকেই চিন্তা করছিলেন যেহেতু তিনি গ্রামের ছেলে গ্রামে অনেক জায়গাও আছে। সেহেতু অধ্যাপনার পাশিপাশি সে জমিতে কিছু করা যায় কি-না। এভাবেই ভাবতে ভাবতে তিনি ইউটিউবে দেখেন ড্রাগন নামের একটি নতুন ফল এসেছে।
পরে তিনি ইউটিউবে আরো ভালোভাবে এই ফল ও ফলের গুনাবলি সম্পর্কে জ্ঞাণ ও ধারণাসহ চাষপদ্ধতি শিখেন। পরে তিনি দু’দিনে জন্য নাটোর যান এবং সেখানের বড় বড় ড্রাগন বাগান পরিদর্শন করেন, তারা কিভাবে চাষ করছেন সে পদ্ধতি দেখেন। পরে উদ্ধুদ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরে ১০ আগস্ট থেকে নিজ গ্রামের ২৮ শতক জমি প্রস্তুত করেন ড্রাগন চাষের জন্য। ফুলবাড়ীতে বহু জায়গায় ড্রাগন চাষ হলেও রেলপাট করে কেউ ড্রাগন চাষ করেনি। তাই তিনি প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন রেলপাটের মাধ্যমে ড্রাগন চাষ করার। এভাবে চাষ করলে দ্বিগুন গাছ লাগানো যায়। এ রেলপাট করতে খরচ হয় অন্যান্য পদ্ধতির চেয়ে দেড়গুন বেশি। আগস্টের ১৭ তারিখে গাছ লাগিয়ে ৮ মাস ১০ দিনের মাথায় প্রথম ফল দেখতে পান মাহমুদুল আলম। বর্তমানে তিনি প্রায় ৬৫ কেজি ড্রাগন ফল হারভেস্ট করেছেন তার বাগান থেকে। ২৮ শতক জমিতে এই ড্রাগন বাগান করতে তার খরচ হয়েছে ৩ লাখ ৮৬ হাজার টাকা।
মাহমুদুল আলমের ড্রাগন বাগানের দেখভালের দায়িত্বে থাকা আব্দুর রহমান বলেন, বছরখানেক আগে কলেজ শিক্ষক মাহমুদুল আলম তার নিজ ২৮ শতক জমিতে ড্রাগন চারা রোপণ করেন। সেগুলোর সঠিকভাবে পরিচর্যার পর এবারে প্রতিটা গাছেই ফল ধরেছে। আর ড্রাগনের ক্ষেত দেখতে আশপাশের মানুষও এখন ভিড় করছেন। অনেকেই জানতে চাইছেন, কিভাবে অল্প সময়ে ফলন আনতে সক্ষম হয়েছি আমরা।
স্থানীয় বাসিন্দ নজরুল ইসলাম ও গোলা কিবরিয়া বলেন, ড্রাগন নামের যে ফল উঠেছে বাজারে তা জেনেছি কিন্তু এর গাছ বা বাগান কেমন তা কখনো দেখিনি। কিন্তু মাহমুদুল আলমের গড়া বাগানে প্রথম দেখেছি ড্রাগন গাছ। ড্রাগন ক্ষেতটি খুব সুন্দর ও পরিপাটি। প্রতিটি গাছেই ফল ধরেছে। ফলটি খেয়েছি। খুবই সুস্বাদু ও রসালো ফল এটি।
গ্রামের কৃষক শহিদুল ইসলাম বলেন, মাহামুদুল আলমের বাগান পরিদর্শন করেছি। খুবই সুন্দর ও লাভজনক চাষ এটি। ড্রাগন ফলের দাম বাজারে বেশ ভালো পাওয়া যায়। এজন্য আমিও পরিকল্পনা করছি আমার জমিতে এ ফলের চাষ করার।
বাগান কলেজ শিক্ষক মাহমুদুল আলম বলেন, আমি একজন কলেজ শিক্ষক। কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি ইউটিউব দেখে এ ফল চাষে উদ্বুদ্ধ হই। এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাগান ঘুরে এ ফল চাষ করতে উদ্বুদ্ধ হই। পরে নাটোর থেকে চারা এনে বাগান তৈরি করি। বেড তৈরি থেকে শুরু করে চারা রোপন ও গাছের পরিচর্যায় এ পর্যন্ত তার প্রায় ৩ লাখ ৮৬ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
লাল, হলুদ ও সাদা তিন প্রকারে ড্রাগন চারা রোপণের মাত্র ৮ মাস ১০ দিনের মাথায় ফল দেখতে পেয়েছি। ইতোমধ্যে বাগান থেকে প্রায় ৬৫ কেজি ফল হারভেস্ট করে বাজারজাত করেছি। পর্যায়ক্রমে ফলন আরও বৃদ্ধি পাবে বলেও আশা করি। এখানে একজন কর্মচারী সবসময় দেখভাল করে পাশাপাশি আগাছা নিড়ানোর কাজের জন্য কিছু নারী শ্রমিককে নেয়া হয়।
সৌখিন এ চাষি আরও বলেন, ইতোমধ্যে আমার বাগানের ড্রাগন ফল বাজারজাত করা শুরু হয়েছে। বর্তমানে ফুলবাড়ীতে এ ফলের যে চাহিদা আছে তা আমরা ফুলবাড়ীর ড্রাগন চাষিরাই পূরণ করতে সক্ষম বলে মনে করি। আমার আরো জমি আছে। এ ফলের বাগান প্রসার করার পরিকল্পনা আছে। ইতোমধ্যে এলাকার অনেকে আমার বাগান দেখে এ ফল চাষে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। আমার বাগানটি দেখতে ফুলবাড়ীর বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ আসে।
ফুলবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রুম্মান আক্তার বলেন, বিদেশি ফল হলেও বর্তমানে আমাদের দেশে ড্রাগনের চাষ শুরু হয়েছে। পুষ্টিগুনে সমৃদ্ধ ড্রাগনে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি, মিনারেল এবং উচ্চ ফাইবারযুক্ত, ফিবার, ফ্যাট, ক্যারোটিণ, ফসফরাস, এসকরবিক এসিড, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৯ রয়েছে। একটি ড্রাগন ফলে ৬০ ক্যালোরি পর্যন্ত শক্তি এবং প্রচুর ম্যাগনেসিয়াম, বিটাক্যারোটিন ও লাইকোপিনের মতো অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট রয়েছে। ডায়াবেটিস ও ক্যানসার প্রতিরোধে ড্রাগন ফল খুবই কার্যকরী।
তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে ফুলবাড়ীতে বেশকিছু বড় বড় ড্রাগন বাগান তৈরি হয়েছে। যা সবসময় পরিদর্শন করাসহ পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে। পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে কৃষক ও খামারীদের বিদেশি ফল চাষের ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলতে কাজ করা হচ্ছে। স্থানীয় কৃষকরা এ ধরণের ফল চাষে উদ্বুদ্ধ হয়ে চাষ শুরু করলে বিদেশি ফলের আমদানী নির্ভরতা কমে আসবে অন্যদিকে ফল চাষ করে কৃষকরা লাভবান হতে পারবেন। এছাড়া নতুন কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে।
আরও পড়ুন: খুলনায় নারী ফুটবলারদের উপর হামলার প্রতিবাদে বারহাট্টায় মানববন্ধন