
আখি মনি। ছবি: সংগৃহীত
ছোটবেলা থেকে মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন আখি মনি। এক সময় স্বপ্ন দেখতেন পড়াশোনা করে একজন প্রকৌশলী হবেন। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাই আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে তার সে স্বপ্ন আজ শেষ হয়ে গেছে। আন্দোলন করতে গিয়ে চোখ-মুখসহ তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতপ্রাপ্ত আখি। সেসব আঘাত তার জীবনকে থামিয়ে দিয়েছে। অসুস্থতায় ভোগলেও অর্থের অভাবে বর্তমানে তিনি করাতে পারছেন না প্রয়োজনীয় চিকিৎসাটুকুও। এ অবস্থায় মানবেতর জীবন কাটছে অসহায় আখি মনির।
নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার গড়াডোবা ইউনিয়নের বাঁশাটি গ্রামের শামীম তালুকদারের কলেজ পড়ুয়া মেয়ে আখি মনি। বাবা দুই বিয়ে করেন। আখির মা তার দ্বিতীয় স্ত্রী। তিনি ২০১২ সালে মারা যান। আখির বয়স তখন আট বছর। মাতৃবিয়োগের পর শিশু আখি ও তার ছোট আরো দুই বোনের ঠাঁই হয় ঢাকার রামপুরা ওয়াব্দা রোড এলাকায় বসবাসকারী নানা-নানির কাছে। এরইমধ্যে মারা যায় নানা নুরুল ইসলামও। সংসারের হাল ধরেন আখি নিজেই। লেখাপড়ার পাশাপাশি জীবিকার তাগিদে শুরু করেন কর্ম। মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজে ব্র্যান্ড প্রোমোশনের কাজ করতেন তিনি। তার কর্মক্ষেত্র ছিল কাওরান বাজার এলাকা।
আখি ছিলেন শেরে ই বাংলা সরকারি কলেজের ২০২৪ সালের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। কিন্তু আর্থিক সমস্যার কারণে কলেজ কর্তৃপক্ষ তার পরীক্ষা বাতিল করে দেয়। যা ছিল তার স্বপ্নভঙ্গের প্রথম ধাক্কা।
এরইমধ্যে শুরু হয় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বৃদ্ধ নানিসহ এলাকার লোকজনের চোখ ফাঁকি দিয়ে বোরকা পড়ে কাজে যাওয়ার কথা বলে সে আন্দোলন যোগ দেন তিনি।
২০২৪ সালের ১৮ জুলাই। রামপুরা ব্রিজ এলাকায় পুলিশের লাঠিচার্জে আখি গুরুতর আহত হন। তার ঠোঁট ফেটে যায়। একটি দাঁত ভেঙে যায় এবং হাতে ও পিঠে মারাত্মক আঘাত প্রাপ্ত হন। আহত হওয়ার পরও থেমে থাকেননি তিনি। ২৪ জুলাই অংশ নেন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সামনে চলমান বিক্ষোভে। ২৮ জুলাই শাহবাগে পুলিশের আরেক দফা লাঠিচার্জে আখির বা চোখে আঘাত লাগে। ফলে চোখ ফুলে ওঠে এবং দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
পুলিশি হয়রানি এখানেই শেষ হয়নি। অফিসে যাওয়ার পথে পুলিশ তার মোবাইল ফোন জোর করে চেক করতে চাইলে তিনি আপত্তি করেন। এতে পুলিশ গালাগালি করে এবং মানসিকভাবে হেনস্তা করে তাকে। পাশাপাশি এলাকায় ছাত্রলীগের কিছু কর্মীর কাছ থেকেও তিনি হুমকি পান। তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ভয় দেখানো হয়।
তবু আখি মনি তার আন্দোলনে অংশ গ্রহণ চালিয়েই যেতে থাকেন। ৩ আগস্ট শহিদ মিনারে গণসমাবেশে, ৪ আগস্ট মিছিলে এবং ৫ আগস্ট লং মার্চ টু ঢাকা' সবখানেই ছিল তার বিপ্লবী উপস্থিতি। তবে ৫ আগস্টের পর তার শরীরের আঘাতগুলো যন্ত্রণাময় হতে শুরু করে। আঘাতগুলো ধীরে ধীরে তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটাতে শুরু করে। একপর্যায়ে কাজ চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে তিনি চাকরিচ্যূত হন।
তার দুই বোনকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন আগেই। চাকরি হারানোর পর সে আর তার নানির জীবন যেন অন্ধকারময় হতে থাকে। চরম অর্থ কষ্টে পড়েন তিনি। আখি কর্মহীন হয়ে পড়ায় পরিবারে দেখা দেয় চিকিৎসা ও খাদ্যসংকট। এ অবস্থায় স্থানীয় কিছু ব্যক্তি ও সামাজিক সংস্থার কিছুট আর্থিক সহায়তায় প্রাথমিক চিকিৎসা চললেও অর্থাভাবে আটকে যায় সম্পূর্ণ চিকিৎসা।
বর্তমানে মানবেতর জীবন যাপন করছেন আখি। তার সবয়েচে বড় হতাশা হল বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কয়েক দফায় তিনি নির্যাতনের শিকার হয়ে আহত হলেও একজন জুলাই যোদ্ধা হিসেবে তালিকায় এখনও তার নাম উঠেনি। অথচ এমন একজন সংগ্রামী, আহত ও প্রতিনিয়ত লড়াইরত তরুণীর নাম তালিকায় থাকাটা অবশ্যই বাঞ্ছনীয় ছিল।
মুঠোফোনে কথা হলে আখি মনি বলেন, আমি এখনও আশা করি কেউ একজন অন্তত বলবেন- ‘তুমি যা করেছো, তা মূল্যবান।’ আমি হারিনি, থামিওনি। আমি আছি, লড়ছি, এবং থাকবো।
তার কণ্ঠে রয়েছে অসহায়ত্ব নয়, বরং এক অদম্য প্রত্যয়। আখি মনির মতো একজন নিঃস্বার্থ ও সাহসী তরুণীর নাম ‘আহত জুলাই যোদ্ধা’দের তালিকায় যুক্ত না হওয়া শুধু একটি নামের অনুপস্থিতি নয়। এটি একটি প্রজন্মের আত্মত্যাগ ও প্রতিবাদের প্রতি অবজ্ঞার প্রতীক বলে জানান সচেতন লোকজন।
মানবাধিকারকর্মী শাহ আলী তৌফিক রিপন বলেন, এখন সময় এসেছে আখি মনির নাম আহত জুলাই যোদ্ধাদের সেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার। এটি শুধুই একজন ব্যক্তির প্রাপ্যতা নয়, এটি ন্যায়বিচারের দাবি।
এ বিষয়ে কথা হলে কেন্দুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইমদাদুল হক তালুকদার বলেন, জুলাই যোদ্ধা আখি মনির সাথে আমার কথা হয়েছে। প্রশাসন তাকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করবে অবশ্যই।
জিয়াউর রহমান