চুরির অপবাদে ‘সালিশে’ কিশোরের মাথা ন্যাড়া, দুই মাতব্বর গ্রেফতার
নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় চুরির অপবাদে সালিশে এক কিশোরের মাথা ন্যাড়া করে দিয়েছে স্থানীয়রা। এর আগে ওই কিশোরকে আটক রেখে রাতভর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। পরে সালিশ বসিয়ে মাথা ন্যাড়া করাসহ ভুক্তভোগীকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
মঙ্গলবার (৮ আগস্ট) উপজেলার বলাইশিমুল ইউনিয়নে ঘটনাটি ঘটলেও শুক্রবার (১১ আগস্ট) ওই কিশোরের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তা জানাজানি হয়। বিষয়টি জানার পর ইউএনও কাবেরী জালাল ও কেন্দুয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আলী হোসেন ঘটনাস্থলে যান।
বিষয়টি জানাহানি হলে সালিশের দুই মাতব্বর স্থানীয় ইউপি সদস্য সবুজ মিয়া ও আবু তাহেরকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মারধরে ধরে অসুস্থ আবুলায়েছকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
শনিবার (১২ আগস্ট) দুপুরে কেন্দুয়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার হোসাইন মোহাম্মদ ফারাবী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। মঙ্গলবার রাতে উপজেলার বলাইশিমুল ইউনিয়নের সরাপাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগী আবুলায়েছ সরাপাড়া গ্রামের বাক প্রতিবন্ধী দিনমজুর আব্দুস সালামের একমাত্র ছেলে।
এলাকার লোকজনও ভুক্তভোগী পরিবারে সাথে কথা বলে জানা গেছে, সোমবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে সরাপাড়া বাজারে মায়ের জন্য মোবাইলের মিনিট কার্ড কিনতে যায় আবু লায়েছ। এ সময় বন্ধ থাকায় শাহীন মিয়া দোকানে গিয়ে ডাকডাকি করে। পাশের চা দোকানি মতিউর তাকে চোর মনে করে পেছন থেকে ঝাপটে ধরেন। ওই চা দোকানি গ্রাম ও বাজারের লোকজনকে ডেকে আনেন। বলাইশিমুল ইউপির ৩নং ওয়ার্ডে ইউপি সদস্য সবুজ মিয়া, সাবেক মেম্বার হাদিস মিয়া, আবু তাহেরসহ আরো কয়েকজনের নেতৃত্বে রাতভর মধ্যযুগীয় কায়দা অমানুষিক নির্যাতন করে। চুরির বিষয়টি স্বীকার না করায় মেরে বস্তায় ভরে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয় মাতাব্বররা। এক পর্যায়ে জান রক্ষায় চুরির বিষয়টি স্বীকার করতে বাধ্য হয় আবুলায়েছ।
পরদিন বিষয়টি নিয়ে বাজারে সালিশে করেন ইউপি সদস্য সবুজ মিয়া ও আবু তাহেরসহ অন্য মাতব্বররা। বিচারে চুরির দায়ে আবুলা য়েছকে মাথা ন্যাড়া করা, ১০টি বেত্রাঘাত ও দুই হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। মাথা ন্যাড়া করে বেত্রাঘাত করার পর ভয়ে লজ্জায় পরিবারের লোকজন ঘরবন্দী হয়ে পড়ে। এমনকি মাতাব্বরদের ভয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতেও যেতে পারেননি আবুলায়েছের পরিবার। এক পর্যায়ে বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানাজানি হলে প্রশাসন তৎপর হয়। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে আবুলায়েছকে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়।
ভুক্তভোগী আবু লায়েছ বলেন, নিকটাত্মীয় অসুস্থ থাকায় খোঁজখবর নিতে সোমবার রাতে মা মোবাইলের মিনিট কার্ড কেনার জন্য গ্রামের সরাপাড়া বাজারে পাঠায়। তখন রাত প্রায় বারোটা বাজে। মিনিট কার্ড কেনার জন্য শাহীন মিয়া দোকানে গিয়ে ডাকাডাকির সময় পেছন থেকে চা দোকানি মতিউর আমাকে ঝাপটে ধরে চোর বলে চিৎকার করে। ধরে ফেলেন। পরে ওই চা দোকানি গ্রাম ও বাজারের লোকজনকে ডেকে আনেন। ইউপি সদস্য সবুজ মিয়া, সাবেক মেম্বার হাদিস মিয়া, আবু তাহেরসহ আরও কয়েকজনের নেতৃত্বে রাতভর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। মেরে বস্তায় ভরে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার হুমকিও দেয় তারা। এক পর্যায়ে গ্রাণ রক্ষায় চুরির বিষয়টি স্বীকার করতে বাধ্য হই।
বিষয়টি নিয়ে পরের দিন সকালে বাজারের ব্যবসায়ী ও গ্রামের মাতব্বরগণ সরাপাড়া বাজারে বসেন এক সালিশ বৈঠকে। এতে সভাপতিত্ব করেন বর্তমান ইউপি সদস্য সবুজ মিয়া। পরে বিচারের মাথা ন্যাড়া করে ১০টি বেত্রাঘাত ও দুই হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
আবুলায়েছের মা নুরেছা আক্তার জানান,বাজারে ১২টা-১টা পর্যন্ত দোকানপাট খোলা থাকে। এই ভেবে জরুরি প্রয়োজনে মিনিট কার্ড আনার জন্য ছেলেকে বাজারে পাঠাই। কিছুক্ষণ পরেই খবর আসে তাকে চোর ভেবে আটক করেছে। তাৎক্ষণিক ছুটে যাই বাজারে। আমার কোনো কথাই তারা শোনেনি। রাতভর আমার ছেলেকে মারপিট করেছে তারা। জান বাঁচাইতে চুরির কথা স্বীকার করে সে। ভাঙা ঘরে থাকি। চালের ওপর পলিটিন দিয়ে ঢেকে রাখছি। চুরির অপবাদ দিয়ে ছেলেডারে ইচ্ছামত মারছে তারা। বিচার কইরা মাথাডা ন্যাড়া করছে। লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছি না। ৫ হাজার জরিমানা ধরলে কাকুতিমিনতি করে দুই হাজার টাকা দিয়েছি। তাও আরেকজনের কাছ থেকে ধার করে এনে দিয়েছি। টাকার জন্য ছেলে চিকিৎসা করাতে পারছি না। এই ঘটনার দুঃখে ক্ষোভে ও লজ্জায় ছেলেডা কারোর সঙ্গ কথা কয় না, ভাতও খায় না। আমার ছেলেডারে সবুজ মেম্বার, হাদিস মেম্বার ও আবু তাহেরসহ কয়েকজনে মিলে মেরে শেষ করে দিয়েছে। আমি এই ঘটনার সঠিক বিচার চাই।
চা দোকানি মতিউর রহমান জানান, বাজারে প্রায়ই চুরি হয়। সেজন্য তিনি সর্তক থাকেন। টিনের শব্দ পেয়ে শাহীন মিয়ার ঘরে গিয়ে আবুলায়েছকে আটক করি। পরে সবাইকে খবর দেই। বিচারের রায়ে আমিও দুটি বেত্রাঘাত করেছি ঠিকই। তবে কষ্টে তার দুই চোখে পানি চলে এসেছিল দাবি করেন তিনি। শাহীন মিয়া জানান, ঘটনার সময় তিনি দোকানে ছিলেন না। খবর পেয়ে বাজারে আসেন। তার দোকানের দরজায় তালা লাগানো ছিল। দোকান ঘরের বেড়ার একটি টিন খোলা ছিল বলে দাবি করেন তিনি।
ভুক্তভোগী কিশোরের চাচা লাইচ উদ্দিন জানান, ভাতিজা আবুলায়েছকে চুরির অপবাদ দিয়ে মেরেছে। সালিশ বৈঠকের বিচারকারীরা ভাতিজার মাথা আমাকে ন্যাড়া করার হুকুম দেয়। চাচা হয়ে ভাতিজার মাথা আমি কেমনে ন্যাড়া করি। পরে তারা নাপিত এনে মাথা ন্যাড়া করেছে। আমরা এখন এই লজ্জায় বাইরে যেতে পারি না। তারা প্রভাবশালী মানুষ।
কেন্দুয়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার হোসাইন মোহাম্মদ ফারাবী জানান, এ ঘটনায় ইউপি সদস্য সবুজ মিয়া ও আবু তাহেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। তবে এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে। বিস্তারিত তথ্য তথ্য বিকেলে জানানো হবে বলেও জানান তিনি।
আরও পড়ুুন: চুরির অপবাদ দিয়ে গ্রাম্য শালিশিতে কিশোরকে নির্যাতনের পর মাথা ন্যাড়ার অভিযোগ