মঙ্গলবার ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১ আশ্বিন ১৪৩০

গীতিকবি মির্জা রফিকুল হাসানের জীবনচিত্র

প্রকাশিত: ২২:১৬, ৪ আগস্ট ২০২৩

গীতিকবি মির্জা রফিকুল হাসানের জীবনচিত্র

গীতিকবি মির্জা রফিকুল হাসান

নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার পৌর সদরের শান্তিবাগ এলাকায় নিজের গড়া বাসস্থানে বসবাস করেন গীতিকবি মির্জা রফিকুল হাসান

তিনি উপমহাদেশের প্রখ্যাত লোক শিল্পী, লোক কবি ও সংগীত পরিচালক একুশে পদক প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম ওস্তাদ মোমতাজ আলী খানের স্মৃতি রক্ষায় প্রতিষ্ঠিত ওস্তাদ মোমতাজ আলী খান সংগীত একাডেমি কর্তৃক প্রবর্তিত লোক গানে বিশেষ অবদানের জন্য “ওস্তাদ মোমতাজ আলী খান পদক ২০২২” এর জন্য মনোনীত হয়েছেন ।

পূর্বে যাঁরা এই পদকে ভূষিত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কিংবদন্তি শিল্পী মলয় কুমার গাঙ্গুলী ও ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও সাংবাদিক মরহুম আশরাফুজ্জামান খান ।

জাতীয় পর্যায়ে এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হওয়ায় লোক ও আধ্যাত্মিক গান নিয়ে তাঁর বাবার হারিয়ে যাওয়া রচনাবলীর দুঃখ কিছুটা প্রশমিত হয়েছে।

মির্জা রফিকুল হাসান পনের শ’র কাছাকাছি গান লিখেছেন । এক যুগেরও অধিক কাল ধরে তাঁর গান বেতার ও টেলিভিশনে প্রচারিত হচ্ছে । কয়েক বছর পূর্বে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাঁকে গীতিকার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।

কিছুদিনের মধ্যেই ঢাকায় আনুষ্ঠানিক ভাবে গীতিকবি মির্জ্জা রফিকুল হাসান কে পদক প্রদান করা হবে বলে একাডেমি পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

মির্জা রফিকুল ইসলাম ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রীসহ দুই পুত্র ও দুই পুত্র বধুঁ এবং বড় পুত্রের ৫ বছর বয়সের নাতনী তাসপিয়াকে নিয়ে যাপিত জীবন যাপন করছেন ।তাঁর দুই পুত্র ও পুত্র বধুঁদ্বয় উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ।

গীতিকবি মির্জা রফিকুল হাসানের পৈত্রিক নিবাস নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার তেতুলিয়া গ্রাম । ঐ গ্রামের সম্ভ্রান্ত মির্জা পরিবারে তাঁর জন্ম ।তিনি ১৩৫৮ বঙ্গাব্দের ২২ শে ভাদ্র জন্মগ্রহণ করেন ।তবে একাডেমিক সার্টিফিকেটে ১৯৫৬ সালের ১৩ জুলাই লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ।তাঁর পিতার নাম মির্জা আব্দুল খালেক এবং মাতার নাম শামছুন্নাহার বেগম ।

উনাঁর পিতা একজন বাউল তাত্ত্বিক ও সূফি সাধক এবং মাতা ছিলেন একজন সাহিত্য অনুরাগী সরল প্রাণের মানুষ । নয় ভাই বোনের মধ্যে মির্জা রফিকুল ছিলেন তৃতীয় ।তিনি একজন তরিকতপন্থী সূফী দর্শনের মানুষ।মাওলানা সৈয়দ শফিউল বশর আল-হাচানী আল মাইজভান্ডারীর একনিষ্ঠ ভক্ত তিনি ।

এই গীতিকবির শৈশব কৈশোর কেটেছে ডিংগাপুতা হাওরের উত্তাল তরঙ্গে সাঁতার কেঁটে,ফুটবল,হাডুডুডু খেলে ।গ্রামের পাঠশালায় লেখাপড়ার হাতেখড়ি হওয়ার পর পঞ্চম শ্রেণী পাশ করে;ধর্মপাশা খোদাবক্স উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়ন করেন ।

মির্জা রফিকুল ইসলাম সেই সময়ের স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে বলেন-একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্কুল কমিটি সিদ্ধান্তে তিনি বহিস্কৃত হন । পরবর্তীতে নিরুপায় হয়ে পার্শবর্তী খুরশিমুল জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জালাল উদ্দিন স্যারের আন্তরিক দয়া ও সহযোগিতায় অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তির সুযোগ পান ।ঐ বছরই তিনি জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষার জন্য মনোনীত হন । ছোট বেলা থেকেই তিনি ছিলেন বিরল প্রতিভার অধিকারী । তখনকার সময়ে তিনি স্বরচিত কবিতা পাঠ ও রচনা প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে প্রথম স্থান অধিকার করার গৌরব অর্জন করেছিলেন। অষ্টম শ্রেণী পাশ করে তিনি আটপাড়া থানার বানিয়াজান সিটি হাই স্কুল ভর্তি হন ।

পড়াশোনা আর খেলার সময় কালেই কিশোর বয়সে আনুমানিক দশ বারো বছর বয়স থেকেই তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন । অল্প বয়সেই নবীন কবি হিসেবে সুনাম ছড়িয়ে পড়ে । পাশাপাশি খেলাধুলায় তিনি ছিলেন পারদর্শী ।

এই গীতিকবি জানান-১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে তিনি আন্দোলন সংগ্রাম আর মিটিং মিছিলে যোগ দেন ।তখন তিনি দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন ।তখনকার সময়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্কুল কলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায়;অকুতোভয় দুরন্ত সাহসী মির্জা রফিকুল ইসলাম আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে পড়েন ।

২০২২ সালের ২ জুলাই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর গীতিকবি মির্জা রফিকুল ইসলামের নিজ বাসভবনে একান্ত সাক্ষাতকারে তিনি আরও বলেন-স্কুল বন্ধের সুবাদে তিনি তখন বাড়ি চলে যান এবং গোপনে তাঁর চিরচেনা প্রিয় স্থান ধর্মপাশায় ঘুরতে যান ।সেই সময়ে ধর্মপাশা গ্রামের বিশিষ্ট রাজনীতিবীদ আব্দুল হেকিমের নেতৃত্বে গোপন জায়গায় বাশেঁর লাটি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন ।

তিনি আরও বলেন-মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের জন্য বন্ধুদের নিয়ে মহিশখলা দিয়ে ভারতে যাওয়ার সময় তাঁর পিতা খবর পেয়ে রাস্তা থেকে জোর করে ধরে নিয়ে আসেন ।পরবর্তীতে জানাশোনা লোকের সাথে ভারতে ট্রেনিং এর জনৗ পাঠানোর আশ্বাস দেন ।

তখন বাংলার প্রতিটি পাড়া মহল্লায় সংগ্রামের দামামা বেঁজে উঠে এমন সময় মির্জা রফিকুলের জননী মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন ।পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য রওয়ানা দিলে পথিমধ্যে শুনতে পান-মোহনগঞ্জ স্বাধীন হয়ে গেছে;শত্রুসেনারা আত্মসমর্পন করতে শুরু করেছে ।তাই গীতিকবি মির্জা রফিকুলের আর মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া হয় নি ।কিন্ত তাঁর কলম যুদ্ধ থামেনি ।তখন থেকে আরও বেশী লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করেন ।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এস.এস.সি পাশ করেন তিনি ।পরে তেজগাঁও পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে ইলেকটিক্যাল ডিপ্লোমা ইন কোর্সে ভর্তি হন । এক সময় তিনি বি.টি.এম.সির অধীনে সাতরং টেক্সটাইল মিলে ইলেক্টট্রিক সুপারভাইজার হিসেবে চাকুরী জীবন শুরু করেন এবং শ্রমিক রাজনীতিতে যোগ দেন ।

তখন মুন্ডা গ্রামের কবি আব্দুল করিম,কবি শরীফ উদ্দিন পাটোয়ারী,কুষ্টিয়ার কবি ও ছড়াকার রুহুল আমিন বাবুলসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্বরচিক কবিতা আবৃত্তিতে যোগদান করতেন বলে জানান গীতি কবি মির্জা রফিকুল হাসান । মির্জা রফিকুল হাসানের সাক্ষাতকার গ্রহনের সময় একান্ত আলাপকালে তিনি বলেন-“স্বর্ণকুমার মালতী কন্যা নামে তিনি”গ্রাম্য যাত্রা দলের জন্য একটি নাটক রচনা করেছিলেন ।নাটকটি কবি শফিক উদ্দিন পাটোয়ারীর পরিচালনায় মঞ্চায়িত হয়েছিল ।

চলমান জীবন প্রবাহের পথ পরিক্রমায় মির্জা রফিকুল হাসান- সাত রং টেক্সটাইল থেকে বদলীজনিত কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি টেক্সটাইল মিলে কাজে নিয়োজিত হন । তখন ঐশী প্রেমের প্রবল আকর্ষনে,অচেনাকে চিনতে,অজানাকে জানতে,অধরাকে ধরতে-আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আত্মমুক্তির লক্ষ্যে তিনি পীরের হাতে বায়াত গ্রহণ করেন ।সেই সময় থেকে আধ্যাত্মিক সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন ।সেখান থেকে বদলী হয়ে কিশোরগঞ্জ টেক্সটাইল মিলে প্রধান বিদ্যুৎবিদ হিসেবে প্রায় আট বছর চাকুরী করেন এবং পীরের অনুমতি নিয়ে চাকুরীতে ইস্তোফা দিয়ে মধ্য প্রাচ্যের দেশ কুয়েতে চাকুরী করেন।

পরবর্তীতে স্ব-ইচ্ছায় ফিরে এসে মুর্শিদ মাওলানার অনুমতিতে আধ্যাত্মিক সাধনা ও গান লিখার প্রতি মনোযোগী ও আত্মনিয়োগ করেন এবং কেন্দুয়ার শান্তিবাগ মহল্লায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে আজ অবধি নিরবে নিভৃতে সাধনায় মনেনিবেশন চলমান রেখেছেন। এই গীতিকবি মির্জা রফিকুল হাসানের প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ অচিনপাখি ও লোকগানে“বঙ্গবন্ধু-শেখ হাসিনা” দ্বিতীয় প্রকাশিত গ্রন্থ ।

আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ভবিষ্যতে তিনি লোকগানের চেয়েও বড় স্বীকৃতি পাবেন। এই প্রত্যাশায় গীতিকবি মির্জা রফিকুল হাসানের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করি ।

আরও পড়ুন: কেন্দুয়ার বাউল সাধক মরমী কবি আব্দুল মজিদ তালুকদার