বুধবার ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১

দুর্জয় বাংলা || Durjoy Bangla

এগিয়েও পিছিয়ে মেয়েরা, এ শিকল ভাঙবে কবে!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০৮:৫৬, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

আপডেট: ১৪:০৬, ২৩ এপ্রিল ২০২৩

এগিয়েও পিছিয়ে মেয়েরা, এ শিকল ভাঙবে কবে!

এগিয়েও পিছিয়ে মেয়েরা, এ শিকল ভাঙবে কবে!

‘মেয়ে মানুষের আবার খেলা কি? এসব ফুটবল খেলে কি হবে? পাড়া প্রতিবেশীরা অনেক সময়েই নানা কথা বলে। পরিবার থেকে বলা হয় মেয়েদের খেলাধুলা ভালো না। মান ইজ্জতের ব্যাপার! কেউ বিয়ে করবে না…।’ বলছিলেন গাইবান্ধার বাদিয়াখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণি পড়ুয়া ফাতেমা আকতার। বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জাতীয় গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের খেলায় সে ‘ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ’ হয়েছিল। 

যদিও তার ইচ্ছে ভবিষ্যতে জাতীয় দলে খেলবে। উজ্জ্বল করবে দেশের নাম। কিন্তু বাঁধা কোথায়? ফাতেমার ভাস্য, খোদ পরিবার থেকেই আপত্তি। রোকসানা আকতার রিয়া এবার পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে। জেলা পর্যায়ে খেলার জন্য নির্বাচিত হয়েও পরিবারের আপত্তির মুখে শেষ মুহূর্তে খেলায় অংশ নিতে পারে নি। তার ইচ্ছে থাকলেও বাবা আর বড় ভাইয়ের চোখ রাঙানোর আর নিষেধই একমাত্র বাঁধা।

আক্ষেপ করে রিয়া জানায়, অনেক শুনেছি দেশের পোস্টারবয়ের কথা, ফুটবল ক্রিকেটে পোস্টারগার্লও আছে শুনেছি, কিন্তু হাতেগোনা, আটকে আছে দু'চার জনের মধ্যে ! আমি পোস্টারগার্ল হবো, দেশের মুখ উজ্জ্বল করবো; ঘরে বেঁধে রেখো না! সুযোগ দাও! 

কয়েক দশক আগেও বাংলাদেশে জনপ্রিয় খেলা  ফুটবলকে দেখা হতো, ‘পুরুষের খেলা’ হিসেবে। মেয়েরা মাঠে গিয়ে বল খেলবে- এটা ছিল রীতিমতো ট্যাবু- যথারীতি নিষিদ্ধ ব্যাপার ছিল। ২০০৩ কিংবা ২০০৪ সালের দিকে মেয়েদের ফুটবল টুর্নামেন্ট বন্ধ করতে মিটিং মিছিল করে বাঁধা দেয়া হয়েছিল, এর বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করতেও দ্বিধা করেনি।  খেলাধুলাকে বলা হয়েছে, মেয়েদের স্বভাব, স্বাস্থ্য ও মর্যাদার পরিপন্থী। মেয়েরা ঘরে থাকবে, লোকচক্ষুর অন্তরালে জীবন কাটাবে- এই তাদের বিধান। 

শুধু ফুটবল নয়! ক্রিকেট, যুব আর্চার, বক্সিং, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন, বাস্কেটবল, টেনিস, সাতার সহ বিভিন্ন খেলায় মেয়েদের অংশগ্রহণ যেন একপ্রকার ট্যাবু। উল্লেখযোগ্য ভাবে অংশগ্রহণ এখনও ধোরা ছোয়ার বাহিরে। 

যদিও নারী কেন্দ্রীক বিভিন্ন দিন দিবসে নারী প্রধানমন্ত্রী, নারী বিরোধী দলীয় নেত্রী, নারী স্পিকারদের নিয়ে গর্বের ফানুস উড়াতে থাকে। বলা হয় নারীর ক্ষমতায়ন। যদিও বক্তৃতামুখর দিন শেষ হলেই চুপসে যায় নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি। 

দেশে পোস্টার'বয়ের আধিপত্য চললেও পোস্টার'গার্ল তৈরিতে কোথায় যেন হোঁটচ খেতে হচ্ছে। কোথায় যেন গলদ, কি আছে অন্তরায়? তবে কি নারীর ক্ষমতায়ন আর লিঙ্গ সমতা অলিক সত্য? 

তবে নারী ক্ষমতায় কি?

সমতার বিশ্ব কেমন হতে পারে, সেটা বোঝাতে লিঙ্গ সমতার প্রতিবেদনে চারটি সূচক ব্যবহার করা হয়েছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ ও অংশগ্রহণের সুযোগ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। ওই চার সূচকে নারী ও পুরুষ সমান সমান হলে বলা যাবে সমতা অর্জন হয়েছে। 

যদিও নারী অধিকার কর্মী তাহমিনা কোরাইশীর দাবি, ক্ষমতায়ন মানুষের বস্তুগত, দৈহিক, মানবিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকও বটে যার সাথে দক্ষতার প্রশ্নটি জড়িত। তিনি মনে করেন, নারীর ক্ষমতায়নের আওতাকে প্রধানত যা বলা হচ্ছে তার বাহিরে বর্তমানে আরও নানাবিধ বিষয় উঠে আসছে। আইনগত, তথ্যগতসহ আরও কয়েক ধরনের ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গ উঠে।

নারীর ক্ষমতায়ন তখনই সম্ভব, যখন কোনও বাধা বা সীমাবদ্ধতা ছাড়াই নারীরা শিক্ষা, কর্মজীবন এবং নিজেদের জীবনধারায় পরিবর্তন আনার জন্য বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধাগুলো ব্যবহারের সুযোগ পান। 

পরিবারেই যখন অসমতার সূত্রপাত

গাইবান্ধা সদরের কামারজানী এলাকার মোসা. রাজিয়া নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘আমার মাইয়্যাও একবার ইশকুল থাইকা খেলতে গেছিল উপজেলায়। কিন্তু নানান কথা কয় মানুষ আর খেলতে দিই নি আমরা। ওসব খেলে আমাগেরে কি হইবো? মাইয়্যা বিয়ে দেয়ার সময় সমস্যা হইবো। কি দরকার ঝামেলার!’ 

মেয়েদের প্রথম বাধাটা আসে পরিবার থেকে, খেলাধুলায় আসতে দিতে চায় না পরিবারের সদস্যরাই। একজন ছেলের ফুটবল খেলা যেভাবে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেয়া হয় একজন মেয়ের ক্ষেত্রে সেটা কট্টর বিরোধী। পরিবার নিরুৎসাহিত করলে একা একটি মেয়ের পক্ষে খেলাধুলা চালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। পরিবার বাধা দেয় মূলত সমাজের চোখ রাঙানি, প্রতিবেশিদের তিরস্কার, ধর্মীয় বাধা নিষেধের ভয় ও সামাজিক কুসংস্কারের কারণে। অসংখ্য মানুষের সামনে মেয়েরা হাফপ্যান্ট, জার্সি পড়ে খেলবে, ছুটবে, দৌড়াবে! পরিবার ও সমাজের অভিভাবকরা তা মানতে পারেন না। 

ফলে যে মেয়েরা মাঠে খেলতে নামে তাকে ও তার পরিবারকে পদে পদে সহ্য করতে হয় সমাজের কটূ কথা, অপবাদ-লাঞ্ছনা। মেয়েদের খেলায় অংশগ্রহণ সমাজ এখনো স্বাভাবিকভাবে সমর্থন তো করেই না বরং নানাভাবে খেলাধুলা বন্ধ করার চেষ্টা চালায়। তাছাড়া অনেক পরিবার মনে করে, খেলাধুলা করলে রোদে বৃষ্টিতে মেয়েদের চেহারার স্বাভাবিক শ্রী নষ্ট হয়ে যাবে। তখন বিয়ে দিতে অসুবিধা হবে। কেননা, এখনও বিশ্বাস করা হয়, বিয়ে করে বাচ্চা লালন পালন করাই মেয়েদের নিয়তি; তাদের স্থান অবশ্যই ঘরের চার দেয়ালের ভেতরে, বাইরের দুনিয়ায় নয়। 

মোসা. লিপি নামের আরেক অভিভাবক বলেন, ‘এগ্লে আমাগেরে মাইয়্যারা খেলে কি করবো? এগ্লে খেলে ভবিষ্যৎ কি! আর গেঞ্জি-হাফ প্যান্ট পইড়া এতো মানুষের মধ্যে কিভাবে খেলে? ছিঃ!লজ্জার বিষয়। আমাদের মাইয়্যাকে মানা কইরা দিছি ওসব খেলা যাইবো না।’ 

এক দশক ধরে পিছিয়ে পড়া মেয়েদের নিয়ে কাজ করা সমাজকর্মী রেজওয়ানা ইসলাম বলেন, ‘যদিও ফোর-জি যুগে রয়েছি আমরা, সবকিছুই এখন আধুনিক। আমাদেরই দুইজন নারী এভারেস্ট জয় করেছেন। কিন্তু প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই সময়েও মেয়েদের খেলাধুলায় আসতে দিতে চায় না পরিবার। আর পরিবার উৎসাহী না হলে একটি মেয়ের পক্ষে খেলাধুলায় আসা বা খেলাধুলা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভবই।’

মাতৃগর্ভে বেড়ে ওঠার অধিকার থেকেও কখনো কখনো মেয়েরা বঞ্চিত হয়, বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতের মতো এশীয় দেশগুলোতে মেয়ে ভ্রুণ হত্যার ঘটনা এ কথাই প্রমাণ করে কতটা বৈষম্যের শিকার মেয়েরা। দুঃখজনকভাবে, বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার এ মেয়েদের বেশিরভাগেরই পরিবার একে ‘স্বাভাবিক’ ব্যাপার বলে মনে করে। 

শহর-গ্রাম-মাঠ কিংবা পুরো দেশই যখন একজন নারীর জন্য শ্বাপদসংকুল এক জনপদে পরিণত হয়, তখন নির্ধারিত কিছু এলাকা, কতিপয় বাস কিংবা বাসের আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত রেখে সমস্যার সমাধানে পৌঁছানো যায় কি? তাবে তো , দেশের প্রতিটি পরিবারেই নারীর জন্য সংরক্ষিত কক্ষ থাকা বাধ্যতামূলক। কারণ, পরিবারেই নারী সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হন। 

‘একটি মেয়ে এবং তার শরীর এমনই নিরাপত্তার বলয়ে পরিবেষ্টিত, যা শেষ পর্যন্ত রক্ষণশীলতার নামান্তর। জার্সি পড়ে মেয়েরা খেলবে, দৌড়াবে, শরীর দোল খাবে, অংসখ্য লোলুপ দৃষ্টি তাকিয়ে দেখবে-অভিভাবকরা তা মানবেন কীভাবে?’ প্রশ্ন তুলেন কলামিস্ট চিররঞ্জন সরকার। 

তিনি বলেন, ‘মেয়েদের হাফপ্যান্ট পরে খেলতে দেখলে ছেলেরা খারাপ হয়ে যাবে বলে মনে করেন সমাজের অনেকেই। লৈঙ্গিক অসমতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আধুনিক সমাজেও তাই মেয়েশিশুরা বেড়ে উঠছে অধিকার বঞ্চিত, নিগৃহীত সমাজের ‘দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক’ হিসেবে।’

স্কুলেই উপেক্ষিত লিঙ্গ সমতা ! 

মেয়ে মানুষের এতো পড়াশোনা কেন করতে হবে? বিয়ে দিয়ে দাও! মেয়ে মানুষ মাঠে খেলবে কেন? বিয়ে হবে খেলে কি হবে?— খেলতে গিয়ে অনেক মেয়েকেই শুনতে হয়েছে এসব বাক্য। এছাড়া ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের রোষানলে পড়তে তো হতেই হয়; এমনকি তির্যক মন্তব্য করা থেকে বাদ যায় না মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকরাও। শুধু তাই নয় স্কুলের অংশগ্রহণমূলক কাজে ছেলে শিক্ষার্থীদের প্রাধান্য বেশি দেয়া হয় অভিযোগ ছাত্রীদের। 

মাধ্যমিক পড়ুয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘খেলায় ছেলেদের সুযোগ বেশি দেয়া হয়। ওদের জন্য নতুন, সুন্দর, দামি জার্সি দেয়া হয় স্কুল থেকে। আর আমাদের দেয়া হয় চার-পাঁচ বছর ধরে ব্যবহার করা ছেঁড়া তালি দেয়া জার্সি। এটাই তো প্রমান করে আমাদের গুরুত্ব স্কুল থেকেই কম দেয়া হয়।’ 

নানাভাবে সংগ্রাম করে মাঠে খেলতে আসা স্কুল পড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থীর মাঠের স্বপ্ন মাঠেই আঁচড়ে পড়ে। চোখে স্বপ্ন থাকলেও পরিবার সমাজ বাধা হয়ে শেষ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হয় স্বপ্ন। 

যদিও ২০১১ সালে সরকারিভাবে দেশ জুড়ে প্রাথমিক স্কুলের মেয়েদের জন্য চালু করা হয় বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্ণামেন্ট। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা থাকায় তখন আর কোন পক্ষের বিরোধিতাই ধোপে টিকেনি। সেই টুর্নামেন্ট ঘিরেই বলা চলে, আজকের তরুণী আর তখনকার কিশোরীদের ফুটবল যাত্রা শুরু। সানজিদা, মারিয়া, সাবিনা, মণিকারা নানা বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে সেই পথ ধরেই জোর কদমে সামনে এগিয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত দেশের জন্য ট্রফি জিতেছেন। 

গেল বছরের মাঝামাঝিতে ‘স্কুলের কাবাডি দলের মেয়েদের মারধর করেন প্রধান শিক্ষক' শিরোনামে খবর আসে জাতীয় দৈনিকে। চট্টগ্রামের এয়াকুব আলী দোভাষ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের কাবাডির ছাত্রীদের কয়েকজনকে বকাঝকার পাশাপাশি চুল ধরে টানাটানি করা হয় ফ্রেঞ্চ স্টাইলে বেণী করার কারণে। ছাত্রীদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ওই ঘটনার প্রতিবাদে নিজের মাথার সব চুল কেটে ফেলে প্রতিবাদ করেন একই স্কুলের শরীরচর্চার শিক্ষিকা জাহিদা পারভীন। যদিও এই দ্বন্দ্বের জেরে থানা পর্যায়ের গ্রীষ্মকালীন ওই ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় শেষ পর্যন্ত অংশ নিতে পারেনি ওই শিক্ষার্থীরা। 

প্রতিবেদনের জন্য গাইবান্ধা শহর ও গ্রামের কয়েকটি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ২৮ জন শিক্ষক-শিক্ষকার নাম প্রকাশ না করার শর্তে মতামত জানতে চাওয়া হয়; তাদের মধ্যে ৮ জন শিক্ষক মনে করেন মেয়েদের খেলা উচিত। ১৬ জন শিক্ষক মনে করেন মেয়েদের খেলা উচিত নয়। আর বাকি ৪ জন শিক্ষক ‘সরকার যা মনে করে' বলে মন্তব্য করেন। যদিও এসব শিক্ষকের মধ্যে খেলতে না দেয়ার পক্ষে পুরুষ শিক্ষকেরই আপত্তি বেশি।

ওই বিদ্যালয়গুলোর মেয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মধ্যে সিংহভাগ শিক্ষার্থী বিভিন্ন খেলায় অংশ নিতে আগ্রহী। তাদের মধ্যে পরিবেশ পেলে খেলতে আগ্রহী ২০ জন। নিজের থেকে আগ্রহী ২৫ জন এবং বাবা মা সম্মতি দিলে আগ্রহী আরো ১৮ জন। ৬৩ জন ছাত্রীর উপর এই জরিপ চালানো হয়। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সদরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা জানান, ‘মেয়েরা বিভিন্ন খেলায় অংশ নিবে এটা স্বাভাবিক কিন্তু আমাদের শিক্ষকদের মধ্যেই অনেক শিক্ষক নানান ভাবে শিক্ষার্থীকে মাঠে না খেলতে নিরুৎসাহিত করে। এছাড়া ওই ছাত্রীর পরিবারের সাথেও এসব নিয়ে সর্তক করে থাকে। ফলে শিক্ষার্থীরা আগ্রহ হারায়।’

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের আরেক শিক্ষক জানান, ‘ স্কুলে উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু স্কুলেই যদি বাঁধা হয়। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে তারা ফুটবল শিখতে চাইলেও বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষকদের তেমন উৎসাহ থাকে না। তাহলে তো প্রতিভা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে।' 

 মাঠের সঙ্কটে পিছিয়ে মেয়েরা 

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি’র এক খবরে বলা হয়, বাংলাদেশে ছোট বড় মিলে ২৬টি ফুটবল ক্লাব আছে, এর মধ্যে ঢাকা এবং এর আশেপাশের জেলাগুলোতে মোট ১৪টি ক্লাব সক্রিয় আছে। ক্লাব পর্যায়ে বেশ কয়েকটি টুর্নামেন্ট হয় বাংলাদেশে। সেগুলো সবই ছেলেদের জন্য। 

বাংলাদেশের কোন ক্লাবেরই মেয়েদের নিয়মিত কোন দল নেই। মেয়েদের জন্য ক্লাব পর্যায়ে ফুটবল খেলার তেমন কোন সুযোগ নেই, নেই ধারাবাহিক কোন টুর্নামেন্টও। 

এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠতেই পারে পোস্টারগার্ল হতে যে প্রাথমিক অনুষঙ্গ প্রয়োজন সেটাই অনুপস্থিত। জেলা শহরের মাঠে খানিকটা খেলার পরিস্থিতি থাকলেও গ্রাম অঞ্চলে এমন সুযোগ একদমই নেই বললেই চলে। একজন ছেলে যেভাবে মাঠে খেলার সুযোগ পায় একজন মেয়ে তা পায় না। এটা বাস্তব! যদিও জেলা শহরের কেন্দ্রীয় মাঠগুলো এখনও টিকে আছে, সেগুলোও আবার ছেলেদের দখলে। মেয়েরা তাহলে খোলা মাঠে খেলবে না? 

গাইবান্ধার অধিকাংশ মাঠ থাকে ছেলেদের দখলে। গ্রামেরও একই অবস্থা, নেই সুযোগ। মেয়েদের ফুটবল বাংলাদেশে এমনিতেই কম হয়। তার ওপর মাঠ সমস্যার কারণে মহিলা ফুটবলের বিকাশ ঠিকমতো হচ্ছে না। যদি মেয়েদের জন্য আলাদা একটি মাঠ পাওয়া যেত, তাহলে অনেক ভাল হতো বলে মনে করেন অনেক কিশোরী। 

ক্রীড়া সাংবাদিক তৌসিফ শাহরিয়ার জানান, ‘দেশে মেয়েদের খেলাধুলা করাটা মোটেও সহজ কোনো ব্যাপার নয়। কারণ অনেক জায়গায় মেয়েদের খেলার কোনো সুযোগই নেই। গ্রামের মাঠেও মেয়েরা খেলার জায়গা পায় না। অনেক মেয়ে আছে যারা জীবনে ফুটবলে একটা লাথি দেয়ার সুযোগ পর্যন্ত পায়নি।’ 

আবাসন আর উৎপাদনের প্রয়োজনে বাংলাদেশের খেলার মাঠগুলো দখল করে গড়ে উঠেছে নানা স্থাপনা। মাঠে খেলা নেই। আর্থিক দিকটাও অনিশ্চিত। মূলত এসব কারণে সব ধরনের জাতীয় পর্যায়ের খেলার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে মেয়েরা ঘরমুখো হচ্ছে। 

ভয়ঙ্কর নারী বিদ্বেষী সমাজ ব্যবস্থা

সমাজ আদিকাল থেকেই ঘোষণা দিয়েছে একজন নারীকে করতে হবে স্বামীর সেবা, জন্ম দিবে বাচ্চা, লালন পালন করতে হবে সন্তান সঙ্গে সামলাতে হবে ঘর-সংসার। তবে উদারতা দেখিয়ে আবার বলা হয়েছে যে, একজন নারী চাইলে পড়ালেখা করে খেলাধুলা কিংবা চাকরিও করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে নারী চাইলেই তা পারে না। তাকে অনুমতি নিতে হয়। বিয়ের আগে পিতামাতার অনুমতি, বিয়ের পর স্বামী এবং শ্বশুর বাড়ি থেকে। তবেই নারী বাইরে পা রাখতে পারে। তাছাড়া সে যদি বাইরে পা রাখেও, তাকে মেনে চলতে হয় সমাজের ধরা-বাধা হাজার নিয়ম। 

সাবেক মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মিনা মাশরাফি মনে করেন,পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বড্ড শ্বাসরুদ্ধ। খুব চমৎকারভাবে সমাজে প্রচার করে যে, নারীকে তার পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। কিন্তু ফলাফল, নারীর জন্য তারা যে চিরাচরিত দায়িত্ব নির্ধারণ করে রেখেছে, সেই দায়িত্ব থেকে রেহাই দেয়নি। কোনো নারী যদি সমাজের সকল বাধাকে অতিক্রম করে উন্মুক্ত স্বাধীনতা উপভোগ করতে চায়, তবে আশেপাশের মানুষের কাছ থেকে আসে নানা অপবাদ, গঞ্জনা, অসম্মান। অথচ যে নারী চাকরির ক্ষেত্রে উচ্চপদে আসীন হয়, তাকে নিয়ে অত্যন্ত মুখরোচক গল্পের অবতারণা হয়।

এই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘কটাক্ষ করা হয়, গায়ের রং! কখনো বেটে কখনো লম্বা বলে আবার কখনো কম হাসি বা বেশি হাসি কিংবা কথা-বেশি কথা নিয়েও। বলা হয় নারীরা ঘরের সো-পিজ!’

তিনি আরো বলেন, ‘প্রগতিশীল সামাজিকতার আড়ালে আটপৌরে সংস্কৃতি চিরকালীন বৈষম্যের প্রতীক; সেখানে নারীদের খেলায় অংশগ্রহণ মানেই সামাজিক অবরোধ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পার করলেও আমাদের দেশের মানুষের মানসিকতা এখনও মেয়েদের খেলাধুলাকে তেমনভাবে সমর্থন করে না।’

মেয়েদের ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট এমনকি ভারোত্তোলনও সামাজিক সমর্থন পায় না। সেখানে নারী ফুটবলারদের অত্যন্ত কৃতিত্ব দেখিয়ে সাফ পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা নিঃসন্দেহে গৌরবময় ও তাৎপর্যপূর্ণ। নিষ্ঠুর সামাজিক অবরোধ থেকে উঠে এসে মেয়েরা যখন বিশাল অতিক্রমণের ইতিহাস তৈরি করেন তখন তারা হয়ে ওঠেন নারীত্বের আলাদা অভিজ্ঞান। ফুটবলে বাংলাদেশে নারীদের উত্থানও তেমনই এক অবিস্মরণীয় আখ্যান। 

এগিয়েও পিছিয়ে কেন মেয়েরা? 

কয়েক বছর ধরে এসএসসি ও এইচএসসিতে মেয়েরা ভালো ফল করে আসছেন। কিন্তু এই ভালো ফল করা মেয়েরা কোথায় যান? তাঁরা কি এই সাফল্য পরবর্তী শিক্ষা ও কর্মজীবনে ধরে রাখতে পারেন? পরিসংখ্যান বলে, পারেন না। 

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতাসহ সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার কথা সরাসরি উল্লেখ আছে। এসডিজির লক্ষ্য ৫-এ লিঙ্গ সমতা অর্জন এবং সব নারী ও মেয়ের ক্ষমতায়ন করা এবং লক্ষ্য ১০-এ বৈষম্য হ্রাস করতে কাজ করার কথা বলা হয়েছে। এসডিজির লক্ষ্য ৩-এ স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন নিশ্চিত করা ও সব বয়সের সবার কল্যাণে কাজ করার কথা বলা হয়েছে। 

কানে ফিসফিসিয়ে মন্ত্র পড়ে দেওয়ার জন্য বহু খালা-ফুপু মজুত থাকে। কী হবে খেলে? সেই তো বিয়ে করে বাচ্চা মানুষ করতে হবে! যেন মরতে হবে বলে কেউ আর বেঁচে থাকার জন্য ভাত খায় না! 

বছর কয়েক আগেও জাতীয় নারী দলের প্রতি কর্তৃপক্ষের অনাদর বুঝিয়েছে। এটা এমন যৌথ পরিবার যেখানে বেশিটা পাওয়া, বড়টা খাওয়া, ভালোটা পরার অগ্রাধিকার পুত্রসন্তানটির। জাতীয় দলের মেয়েদের ডায়েট, ট্রেনিং, কিটস সবেতেই কার্পণ্য। কোনও বাণিজ্যিক সংস্থা মেয়েদের জার্সিটি পর্যন্ত স্পনসর করত না। ফেডারেশন একটা ব্র্যান্ডেড কোম্পানি থেকে সরাসরি কিনে দিত মেয়েদের। অথচ আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিং -এ বরাবর নারী দল পুরুষ দলের থেকে অনেক সন্তোষজনক স্থানে। জাতীয় পুরুষ দলের বিলাসের পাশে মেয়েদের ফুটবলের প্রতি এই অবহেলা দেশের সমাজচিত্রে পৌরুষের জয়গান নয় কি?

নারীর ক্ষমতায়নের স্বার্থেও নারী ফুটবলকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া দরকার। এ জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে বলে জানান জেলা ফুটবলের সাবেক কোচ মান্নান সৈয়দ মোল্লা।

তিনি জানান, ‘ফুটবলকে মেয়েদের জন্য পক্ষপাতমুক্ত হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এ সাফল্য ধরে রাখতে হলে উন্নত প্রশিক্ষণ ও পরিচর্যার মাধ্যমে মেয়ে ফুটবলারদের মানোন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। সারা দেশে তৃণমূল পর্যায় থেকে কিশোর-কিশোরীদের বাছাই করে নিয়মিত ফুটবলের প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। ক্রিকেটে এ ধরনের উদ্যোগের সুফল পাচ্ছি আমরা। ফুটবলের ক্ষেত্রেও একই পদক্ষেপ নেওয়া হলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ খেলায় আমাদের ব্যর্থতা ঘুচবে অবশ্যই। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় খেলা ফুটবলকে অবহেলা করার সুযোগ নেই।’

শুধু শিক্ষা বা ক্রীড়ায় নয়, সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রেও যদি এই দুস্তর ব্যবধান খানিক কমানো যেত, তাহলে মেয়েরা কোথায় যেতেন? বারবার পরীক্ষা দিয়ে, সে পরীক্ষায় পাস করেই মেয়েরা সবার নজর কেড়েছেন, স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছেন বারংবার। সুযোগ পেলে এসব মেয়েই যে আকাশ ছোঁবেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

যদিও জাতিসংঘ জানাচ্ছে, বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব–১৬ বছর এমন মেয়েদের অর্ধেকই পুষ্টিহীনতায় ভোগে। এছাড়া শিক্ষার সুযোগ থাকার পরেও প্রায় ৪২ শতাংশ মেয়ে স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারে না। আর সহিংসতা, সে তো প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা। দেশের ৫৪ শতাংশ নারী তাঁদের নিকটজনের হাতে কোনো না কোনো সময়ে নিগ্রহের শিকার হন। প্রতিটি ক্ষেত্রে অব্যাহত এই বৈষম্য সত্ত্বেও মেয়েরা এগোচ্ছেন।

কেউ কথা রাখে না! 

প্রথম আলোর খবর, দেশসেরা স্বরলিকারা ফোনের ওপাশে কেবলই কাঁদে' খবরে বলা হয়, ২০১৭ সালে যারা জাতীয় পর্যায়ে তৃতীয় স্থান অর্জন করেছিল, এখন তারা হাইস্কুলে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ১৭ জনের মধ্যে ৭ জনের বিয়ে হয়েছে। ১০ নম্বর জার্সিধারী স্বরলিকা পারভীন, ১ নম্বর গোলরক্ষকসহ ৭ জন আর নেই মাঠে। দুইজনের সন্তান হয়েছে। কথা হলো জান্নাতুল, তানজিলা তিথি, সুমাইয়া খাতুন, লাইজু, জামিয়া জুঁই, বিজলী লাইজু ও শিল্পীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী তাদের হাতে জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা করে পুরস্কার দেন। আর প্রাইজমানি তারা পায় ৫০ হাজার টাকা। এলাকায় ফেরার পর, আর কোনো রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পায়নি। কেউ খোঁজ রাখেননি। জেলা ক্রীড়া সংস্থা, মহিলা ক্রীড়া সংস্থা তাদের কোনো খোঁজ নেয়নি। কথাও রাখে নি!

ফোনে স্বরলিকা বলেন, ‘আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে। আমি তো পারব না। ’

২০১৭ সালে হ্যাটট্রিক কন্যা হিসেবে খ্যাতি পায় স্বরলিকা। দল সেমিফাইনালে হেরে তৃতীয় হলেও টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হয় সে। তার হাতে দেশসেরার পুরস্কার তুলে দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

সারা দেশে মাঠ কমে যাচ্ছে। স্কুলের প্রাচীরে মার্কেট ও মাঠগুলো হাটে পরিণত। যেখানে হাট নেই, সেখানে আবাদি জমি। কোথাও অপরিকল্পিত ভবন। বছর বছর শিক্ষার্থী বাড়ে, কিন্তু মাঠ ছোট হয়ে আসে। কিন্তু গ্রামে ধানখেতে, চরগুলোতে চাইলেই খেলাধুলা করা সম্ভব। কিন্তু শহর? শহরে সেই সুযোগ নেই। জাতীয় গৌরব তাই গ্রামই জোগান দেয়—সাকিব আল হাসান থেকে বান্দরবানের রুপনা চাকমা পর্যন্ত। জেলা শহরে টাকা আসে আর বাবুদের পকেটে যায়। আর দুমুঠো ভাতের জন্য স্বরলিকারা হারিয়ে যায়। ফোনের ওপাশে কাঁদে! 

সম্প্রতি প্যারিসে অনুষ্ঠেয় অলিম্পিক ফুটবল বাছাই পর্বের জন্য বেশ কিছুদিন ধরে অনুশীলন করে যাচ্ছিল বাংলাদেশের মেয়েরা। সেই দলে ছিলেন আনুচিং মগিনি-সাজেদে খাতুনেরাও। কিন্তু ২১ জানুয়ারি বিকেলে টিম মিটিংয়ে তাদের ডেকে বলা হয় ক্যাম্প ছাড়তে হবে। সেদিনই খাগড়াছড়ির বাড়িতে চলে যান মগিনি। 

এর একদিন পর অভিমানে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জাতীয় দল থেকে অবসরের ঘোষণা দেন সাফজয়ী দলের এই ফুটবলার। তবে তখনও জানা ছিল না; কি করতে যাচ্ছেন ক্যাম্প ছাড়তে বলা বাকি ফুটবলাররা। অবশেষে মগিনির বিদায় বলার একদিন পর বিদায় জানালে তারই আরেক সতীর্থ ফুটবলার।সাফজয়ী দলের সদস্য সাজেদা খাতুন সোমবার (২৩ জানুয়ারি) নিজের ফেসবুকে পোস্টের মাধ্যমে ফুটবল থেকে অবসরের ঘোষনা দেন। 

মাত্র ২০ বছরে বয়সে ফুটবলকে বিদায় জানানোর সিদ্ধান্ত জানিয়ে ফেসবুকে সাজেদা লেখেন, ‘বিদায় একদিন সবাইকেই নিতে হবে ফুটবল ক্যারিয়ার থেকে। আজকের পর থেকে ফুটবল ক্যারিয়ারকে বিদায় দিলাম। নতুন করে জীবন শুরু করতে চাই।’

এর আগে আনুচিং মগিনি নিজের ফেসবুকে লেখেন, ‘আজকের পর থেকে ফুটবলকে বিদায়।’ গণমাধ্যমে তিনি জানান, ‘আমাকে বলা হয়েছে বাড়িতে গিয়ে ভালো করে প্র্যাকটিস কর, পরবর্তীতে ব্যাক করতে পারবা। এটা মেনে নিতে পারব না আমি।’

গেল ১০ বছরে ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের ঊর্ধ্বমুখী সাফল্যের তালিকা তৈরি করতে গেলে অনুমিতভাবেই শীর্ষে থাকবে ক্রিকেট ও ফুটবল। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছে নারী ক্রিকেট দল এবং নারীদের বয়সভিত্তিক ফুটবল দলগুলো। 

দলগত সাফল্যের পর নজর দেওয়া যাক ব্যক্তিগত অর্জনে। আন্তর্জাতিক মঞ্চে অসাধারণ নৈপুণ্য দেখানো ক্রীড়াবিদদের তালিকাটা বেশ লম্বা। দেশের জন্য তারা নিয়ে এসেছেন গৌরবের মশাল। তাদের মধ্যে সাঁতারু মাহফুজা খাতুন শিলা, ভারোত্তোলক মাবিয়া আক্তার সীমান্ত, ফুটবলার সাবিনা খাতুন, দাবাড়ু শারমিন সুলতানা শিরিন ও আর্চার ইতি খাতুনের নাম উল্লেখযোগ্য। 

প্রখ্যাত সাবেক টেনিস খেলোয়াড় জোবেরা রহমান লিনু, যিনি ১৬ বার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাংলাদেশের একমাত্র নারী ক্রীড়াবিদ হিসেবে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম উঠিয়েছেন, তিনি গেল দশকের নারী ক্রীড়াঙ্গনের সাফল্য ও প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বলেছেন, ‘বিভিন্ন ইভেন্টে আমরা সাফল্য পেয়েছি। বিশেষ করে ক্রিকেট ও ফুটবলে। সেখানে পৃষ্ঠপোষকতাও বেশি। অন্যান্য ইভেন্টে কিন্তু সেভাবে নেই। তবে আমাকে বলতে হচ্ছে যে আমরা যতটা আশা করেছিলাম, ততটা এগোতে পারিনি। আমার মতে, এখানে মূল বাধা হলো আর্থিক বিষয়টি। এখানে ঘাটতি আছে। খেলার মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ খুব কম। ক্যারিয়ার হিসেবে নেওয়া তো দূরের ব্যাপার, ভাববার অবকাশই কম!’

কেবল দক্ষিণ এশিয়ান (এসএ) গেমসের সাফল্য দিয়ে গেল দশকের নারীদের সাফল্য পরিমাপ করার সঙ্গে অবশ্য একমত নন লিনু। এশিয়ান পর্যায়েও অর্জনের ঝুলি সমৃদ্ধ করার প্রত্যাশায় আছেন তিনি, ‘১৯৮০ সালে এশিয়ান গেমস টেবিল টেনিসে আমি পঞ্চম স্থান লাভ করেছিলাম। ৪০ বছর পেরিয়ে গেল। এখনও সেই অর্জনের পুনরাবৃত্তি হয়নি কিংবা কেউ ছাপিয়ে যেতে পারেনি। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমি ফেডারেশন থেকে ন্যূনতম সুবিধা পেয়েছি, যা হলেই নয়। এখনও কি সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে?’ 

সাংগঠনিক কাঠামোতে যে নারী উপস্থিতি থাকা দরকার, সেদিক থেকে অনেক পিছিয়ে। খেলোয়াড়রা এত ভালো করছে, অথচ তাদের জন্য না নারী কোচের ব্যবস্থা করতে পারছে সংস্থা, না পারছে নারী ফিজিও, ম্যানেজার বা ট্রেনার দিতে।

ঘরে বেধে রেখো না! 

বৃহত্তর পরিসরে হয়তো এ প্রসঙ্গে কথা বলা তুলনামূলকভাবে সহজ, কিন্তু বাড়ির ভেতরে বা পরিবারের মধ্যে কীভাবে লিঙ্গবৈষম্য জড়িয়ে থাকে এবং সমাজ কীভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে, তা সকলের বোঝার মত করে বলাটা কঠিন।

‘ফুটবল খেলাটা সহজ ছিল না। কখনো পরিবার থেকে, কখনো গ্রামের মানুষের কাছ থেকে বাধা আসতো। মেয়েরা ফুটবল খেললে বিয়ে হবে না, এ রকম কথাও আসতো। বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ টুর্নামেন্ট চালু হওয়ার কারণেই আজ আমরা সাফজয়ী হতে পেরেছি।’ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজিত ‘বই বিতরণ উৎসব ২০২৩’ এ যোগ দিয়ে জাতীয় নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড় সোহাগী কিসকু এ কথা বলেন। 

আরেক খেলোয়াড় মারিয়ার বলেন, ‘বয়স যখন তিন বছর তখন তার বাবা মারা যায়। ঘরে তিন মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে জীবন সংগ্রামে নামেন আমার মা এনোতা মান্দা। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময় মাঠে দিনমজুরের কাজ করে ফুটবল খেলার বুট কিনেছিলাম আজকের এই আমি।’ 

একের পর এক ফ্ল্যাশলাইটের ঝলকানি, সারাদেশের মানুষের প্রশংসা-সমর্থন, দেশে ফেরার পর ছাদখোলা বাসে উল্লাস। সাফ চ্যাম্পিয়ন জয়ের পর মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে পাল্টে গেছে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড়দের জীবন! 

মেয়েদের ঘরে বেঁধে না রেখো বরং সুযোগ দিয়ে তাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। একদিন তারাই হয়ে উঠবে বাংলার মুখ। অবাক তাকিয়ে রবে পুরো বিশ্ব– আলোচনায় এসব কথা উঠে আসে। যদিও সফল এই খেলোয়াড়দের দাবি, সুযোগ করে দিলে মেয়েরাও পারবে, বাঁধা দিয়ে প্রতিভা বিনষ্ট করলে দেশের ক্ষতি। 

প্রতিবন্ধী মেয়ে শিশুরাও পাচ্ছে না খেলার সুযোগ

যেখানে খেলাধুলায় স্বাভাবিক মেয়েরাই বঞ্চিত সেখানে কিছুটা অপূর্ণতা নিয়ে জন্ম নেয়া শিশুদের তো কথা বলাই বাহল্য আর যদি সে হয় মেয়ে শিশু।অপ্রতিবন্ধী মানুষের পাশাপাশি প্রতিবন্ধী মানুষেরও খেলাধুলার ক্ষেত্র দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু নানান জটিলতায় সে সুযোগ পাচ্ছে না বাংলাদেশের মেয়ে শিশুরা। ক্রিকেট, বাস্কেটবল, টেবিল টেনিস, হুইলচেয়ার দৌড়, গোলক নিক্ষেপ সহ আন্তর্জাতিক মানের খেলাধুলায় পারদর্শী প্রতিবন্ধী মানুষেরা। প্রতিবন্ধী ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও অংশ নিচ্ছে খেলাধুলায় তবে তা সংখ্যায় কম। 

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আবদ্ধ ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। খেলাধুলার মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি হয় ও নিজের সক্ষমতা সম্পর্কে সম্মুখ ধারণা লাভ করে এবং পাশাপাশি সমাজের মানুষের প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা লোপ পায় বলে মনে করেন জেলা শহরের এক অটিজম কেয়ার সেন্টারের পরিচালক মুহম্মদ আলাউদ্দীন। 

এছাড়া দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষেরা সব নিয়ম বজায় রেখে মূল স্রোতোধারার টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করতে পারে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষ ব্রেইল বোর্ডে দাবা খেলার আয়োজন করা হয়। যাকে ব্রেইল চেসও বলা হয়ে থাকে। 

একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থার ছত্রছায়ায়, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষদের বেশ কিছু আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ফিদে নামক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা ও আন্তর্জাতিক ব্রেইল দাবার সব নিয়ন্ত্রণ ইন্টারন্যাশনাল ব্রেইল চেস অ্যাসোসিয়েশন (আইবিসিএ) এই আয়োজন করে থাকে। এই সংস্থার উদ্যোগে গেল কয়েক বছর ধরে ভারতের কর্ণাাটক প্রদেশের মানিপাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষদের এশিয়ান দাবা প্রতিযোগিতা। যেখানে অংশগ্রহণ করে এশিয়ার অন্যতম চার দেশ ভারত, বাংলাদেশ, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কা।

এই চার দেশ থেকে মোট ২২ জন (ভারত ১৫,শ্রীলঙ্কা ৩, বাংলাদেশ ২ ও ফিলিপাইন ২) দৃষ্টি প্রতিবন্ধী খেলোয়াড় এই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেন। আন্তর্জাতিক রেটিং অনুযায়ী গেল বছর বাংলাদেশের টপ দুজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী খেলোয়াড় এযাজ হোসেন এবং বাপ্পি সরকার বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেন। মোট ৮ রাউন্ডের এই টুর্নামেন্ট দিন দশেকের মতো চলে। ৭ পয়েন্ট নিয়ে টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ান হন ২৪ বছর বয়সী একজন ভারতীয় তরুণ মেধাবী দৃষ্টি প্রতিবন্ধী খেলোয়াড় কিষান গাঙ্গুলী। ৫ পয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশের এযাজ হোসেন ৭ম এবং ৪.৫ পয়েন্ট নিয়ে বাপ্পি সরকার ১১তম হন। পর্যায়ক্রমে ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কার অবস্থান রয়েছে

এত সাফল্যের পরও এই সংখ্যা তো বাড়ছেই না বরং কমছে। প্রতিবন্ধীদের সুযোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের সুনাম বয়ে আনতে দ্বিধাবোধ করবে না। 

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সম্পর্কে জাতিসংঘের সম্মেলনে বলা হয়েছে, অনুচ্ছেদ ৩০-এ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সম্ভবপর শারীরিক ক্রিয়াকলাপ ও খেলাধুলাতে অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান নিশ্চিত করতে দেশকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলা হবে। 

ধর্মের দোহাই দিয়ে অনেকে মেয়েদের অগ্রযাত্রা রুখতে চায় 

সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংসকারের কারণে আমাদের দেশের ক্রীড়াঙ্গন থেকে মেয়েরা প্রায় নির্বাসিত। এটাকে বলা যায় ‘সুপরিকল্পিত কুসংস্কার’। এমন ভাবনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের নারী ক্রীড়া।

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলায় মেয়েদের ফুটবল বন্ধের দাবিতে ২০১৮ সালে। ওই বছরের ৮ মার্চ শুরু হয় নাগেশ্বরী উপজেলার কলেজ মাঠে রোমানা স্পোর্টিং ক্লাবের আয়োজনে মেয়েদের ফুটবল টুর্নামেন্ট। এই খেলা বন্ধের দাবিতে ১৪ মার্চ বিক্ষোভ করে প্রশাসনের কাছে স্মাররকলিপি দেয় ইসলামী আন্দোলনের স্থানীয় কমিটি।

কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, পিছিয়ে নেই মুসলিম দেশগুলোও। তুরস্ক, প্যালেস্টাইন, মরক্কো, তিউনিসিয়া, জর্ডান, সিরিয়া, মিশর, আরব আমিরাতের রয়েছে নারী ফুটবল দল, আজারবাইজান ২০১২ সালে এবং জর্ডান ২০১৬ সালে নিজ দেশে আয়োজন করেছে ফিফা নারী বিশ্বকাপ টুর্নামেন্ট। ২০০৬ সালে সৌদি আরবে প্রথম নারী ফুটবল টিম গঠিত হয়, প্রিন্স আল ওয়ালিদ বিন তালাল এর উৎসাহে। কিন্তু মেয়েদের প্রকাশ্যে  লিগ বা টুর্নামেন্ট খেলার অনুমতি মিলতে লেগেছে অনেক সময়। অবশেষে এ বছরই (২০২২) মালদ্বীপে অনুষ্ঠিত একটি আর্ন্তজাতিক ম্যাচে সিশেলসকে ২-০ গোলে হারিয়ে আলোচনায় উঠে এসেছে সৌদি জাতীয় নারী ফুটবল টিম। 

সাফ গেমসে বাংলার সোনার মেয়েদের সাফল্যে আজ আনন্দে উচ্ছ্বাসে ভেসে যাবার সময় তাই মনে রাখতে হবে, কেবল রক্ষণশীল সমাজ নয়, খোদ খেলার জগতের ভেতরের অনেক মানুষ নিশ্চয় ভ্রু কুঁচকাচ্ছে মেয়েদের এই প্রাপ্তিতে, নিশ্চয় মুখ কালো হয়ে যাচ্ছে অনেকের এই ভেবে যে, হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে জনপ্রিয়তা, অর্থ, বিজ্ঞাপন; খেলার মাঠ আর টুর্নামেন্ট, মিডিয়ার মনোযোগ আর সম্প্রচার স্বত্ত বেদখল হয়ে যাচ্ছে- এই প্রাপ্তি সাবিনা-কৃষ্ণাদের পথ ভবিষ্যতে আরও বন্ধুর করে তুলতে পারে। আজ থেকে ১০০ বছর আগে ডিক ক্যার নারী দলের সাফল্য যেমন কাঁটা হয়ে ফুটেছিল পুরুষশাসিত এই স্পোর্টস দুনিয়ায়। কিন্তু ১০০ বছর আগেও পারেনি, এখনও দামাল মেয়েদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না! 

নারীদের খেলায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে কেবল রক্ষণশীল সমাজ বা ধর্মীয় নেতারাই সোচ্চার তা নয়, বরং সমাজের ভেতর গভীর ভাবে প্রোথিত পুরুষতান্ত্রিকতা ফুটবলের মত পৌরুষদীপ্ত খেলায় মেয়েদের অংশগ্রহণ মেনে নিতে পারে না। মেনে নিতে পারে না এই বিপুল জনপ্রিয় খেলার অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়ও। ২০২০ এ চেলসি দল নারী ফুটবলার হার্ডারকে আড়াই লক্ষ পাউন্ডে চুক্তি করার পর নড়েচড়ে বসেছিল পুরুষ ক্লাবগুলো। আর এ মাসেই ব্রিটিশ নারী ফুটবলার কেইরা ওয়ালস বার্সিলোনা ক্লাবে যোগদান করেছেন চার লক্ষ পাউন্ডের বিনিময়ে, যে খবর স্পোর্টস দুনিয়াকে নাড়িয়ে দিয়েছে। 

পরিসংখ্যান কি ইঙ্গিত করছে?

লিঙ্গ সমতা নিয়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সর্বশেষ ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ’ রিপোর্ট বলছে, বর্তমানে ১৪৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭১তম। এর বাইরে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নবম, অর্থনৈতিক অংশগ্রহণের দিক দিয়ে ১৪১তম, শিক্ষায় ১২৩তম, স্বাস্থ্য সেবাপ্রাপ্তির দিক দিয়ে ১২৯তম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এসবের মধ্যে অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ও স্বাস্থ্য সেবাপ্রাপ্তির দিক দিয়ে এগোলেও পিছিয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, শিক্ষাসহ সামগ্রিক লিঙ্গ সমতায়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ সালের প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬। এর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৮ কোটি ১৭ লাখ ১২ হাজার ৮২৪ জন এবং নারীর সংখ্যা ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ২০৬ জন। সে হিসাবে পুরুষের চেয়ে নারী বেশি ১৬ লাখ ৩৪ হাজার ৩৮২ জন। গত দশ বছরে দেশে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। তবে নারী-পুরুষ লিঙ্গভিত্তিক বিবেচনায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খেলাধুলায় অংশ কমেছে। 

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, বাবা-মায়েরা তাদের কন্যাসন্তানকে সহিংসতার ভয়ে কোচিংয়ে, স্কুলের পিকনিকে, খেলাধুলায়, এমনকি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে নিরুৎসাহিত করেন। 

বিবিএস, ব্যানবেইস ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের জরিপ বা সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, বর্তমানে ১০০ জন নারীর বিপরীতে পুরুষ ৯৮ জন। তবে প্রভাব ফেলেছে নারীদের স্বাক্ষরতার হার ও সামগ্রিক লিঙ্গ সমতায়। এছাড়া, অনলাইন-অফলাইনে যৌন হয়রানির ভয়ে শিক্ষাগ্রহণ, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে সরে আসছে নারীরা। ফলে সমতা নিশ্চিতের পথে অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। 

সমতায় বাধা কী?

মেয়েরা টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন, দাবার মতো ঘরোয়া (ইনডোর) খেলাগুলোতে অন্ততপক্ষে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও প্রত্যাশিত জায়গায় যেতে পারেনি এই খেলাগুলো। পাশাপাশি মেয়েদের জন্য প্রত্যাশিত সুযোগ-সুবিধাও সেভাবে বাড়ানো যায়নি। তা ছাড়া মেয়েদের সামনে আদর্শ নারী ক্রীড়াবিদের অভাবও রয়েছে। তবে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের মেয়েদের খেলাধুলা নিয়ে আমি হতাশ নয় বলে সাবেক নারী কোচ দিপালি। 

অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে না পারলে মেয়েদের খেলাধুলা বেশি দিন টিকবে না। এ কথা আমি নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে। মেয়েরা খেলাধুলায় খুব বেশি আসবেও না সামনে। জীবিকার জন্য মেয়েরা খেলা থেকে ভালো অর্থ না পেলে নিরুৎসাহী হবেই। আর্থিক ব্যাপারটা বাড়ানো গেলে আরও বেশি মেয়ে খেলায় আসবে আমার বলে বিশ্বাস করেন দিপালি।

স্পনসরদের উচিত মেয়েদের খেলাধুলার পাশে দাঁড়ানো। অথচ সব সময় দেখা যায়, ছেলেদের বড় বড় টুর্নামেন্ট (ফুটবল, ক্রিকেট) টাকা দেয় স্পনসর। ছোট ছোট খেলা স্পনসর করতে চায় না। ফলে ছোট খেলার ছেলেমেয়েদের আর্থিক যোগটা সেভাবে হয় না।

নারী খেলোয়াড়দের এই অবস্থা দেখে নতুনেরা আসতে চায় না আর খেলায়। এলেও কিছুদিনের মধ্যে অনেকে ঝরে যায়। অনেক সম্ভাবনাময় মেয়ে খেলা চালিয়ে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সহযোগিতা পায় না। পরিবারও দেখে যে, খেলায় তো তেমন কোনো ভবিষ্যৎ নেই। খেলায় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখার পরও অনেক মেয়েকে বাল্য বিবাহের শিকার হতে হচ্ছে।  দায়বদ্ধতা আরও বাড়ানো উচিত। তাহলে লিঙ্গ অসমতা দূর হবে। নাহলে আজকে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে আছি, আগামীতে হয়তো এই স্থানও হারাবো। 

বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের সাবেক সভাপতি দিলারা মিজবাহ বলেন, ‘লিঙ্গ সমতা তৈরি করতে সরকার কতটুকু দায়বদ্ধ? এটাই মূল জায়গা। সরকার পদক্ষেপ না নিলে লিঙ্গ সমতায় পৌঁছাতে পারবে না নারীরা। সেই সঙ্গে নারী আন্দোলন যে সমস্যাগুলো তুলে ধরছে সেগুলোতে দৃষ্টি দিতে হবে। আর নারীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় আনতে হবে। এগুলো করলে অসমতা আস্তে আস্তে কমানো সম্ভব।’

কন্যাশিশুদের প্রতি থাকতে হবে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি

ইউনিসেফ বাংলাদেশ-এর প্রোগ্রাম অফিসার (জেন্ডার) তাহমিনা হক বলেন, ‘কন্যাশিশুদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তাদের সুন্দর ভবিষ্যত গড়তে ও সুনাগরিক হতে সহায়ক। যখন কন্যা শিশুদের মূল্যায়ন করা হয় তখন তাদের প্রতি পিতামাতা এবং পরিবার বিনিয়োগ করে, তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য অধিকার নিশ্চিত করা হয়। কন্যাশিশুদের প্রতিভা ও নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ নিশ্চিত করা হয়।’

তিনি আরো বলেন, ‘পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীশিশুদের প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি তাদের উন্নয়নের ও বিকাশের বিভিন্ন সুচকে পিছিয়ে রাখে। তাই ছোটবেলা থেকেই ছেলেশিশু ও কন্যাশিশুদের সমানভাবে মূল্যায়ন করা, কন্যাশিশুদের সম্পদ মনে করা, তাদের প্রতি বিনিয়োগ করা, দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ প্রাপ্তিতে সহায়তা করা, বিশেষত কন্যা শিশুদের মধ্যে ক্ষমতায়নের বোধ জাগ্রত করা প্রয়োজন। খেলাধুলায় অংশ নিতে দেয়া সহ একইভাবে সমাজে কন্যা শিশুদের প্রতি সামাজিক রীতি আরোপিত বাধাসমূহ, যা তাদের অধিকার প্রাপ্তি ও প্রতিভা বিকাশের অন্তরায় তা দূর করে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির চর্চার মাধ্যমে লিঙ্গ সমতার বৈষম্য কমিয়ে আনা সম্ভব।’

সমাজ, সংস্কার, পিছুটান অনবরত সামনে এগিয়ে চলার গতির পায়ে লাগাম পরানোর চেষ্টা করেছে। থমকে দিতে চেয়েছে এগিয়ে চলার গতি। কিন্তু অদম্য জেদ, অফুরান উৎসাহ-উদ্দীপনার কাছে তা হার মেনেছে বার বার। ‘মুখোশ’- এর যাবতীয় চক্রান্ত ভেস্তে দিয়ে মেয়েরাই হয়ে উঠছেন ‘মুখ’। 

আরও পড়ুন: যরত মুহাম্মদ (স:) বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণ

মলি আকতার

শীর্ষ সংবাদ:

ঈদ ও নববর্ষে পদ্মা সেতুতে ২১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা টোল আদায়
নতুন বছর অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রেরণা জোগাবে: প্রধানমন্ত্রী
কলমাকান্দায় মোটরসাইকেলের চাকা ফেটে তিনজনের মৃত্যু
র‌্যাব-১৪’র অভিযানে ১৪৫ পিস ইয়াবাসহ এক মাদক ব্যবসায়ী আটক
সবার সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করুন: প্রধানমন্ত্রী
ঈদের ছুটিতে পর্যটক বরণে প্রস্তুত প্রকৃতি কন্যা জাফলং ও নীল নদ লালাখাল
কেন্দুয়ায় তিন দিনব্যাপী ‘জালাল মেলা’ উদযাপনে প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত
ফুলবাড়ীতে ঐতিহ্যবাহী চড়কসহ গ্রামীণ মেলা অনুষ্ঠিত
কেন্দুয়ায় আউশ ধানের বীজ বিতরণ ও মতবিনিময় অনুষ্ঠিত
কলমাকান্দায় দেশীয় অস্ত্রসহ পিতাপুত্র আটক
ঠাকুরগাঁওয়ে গ্রামগঞ্জে জ্বালানি চাহিদা পূরণ করছে গোবরের তৈরি করা লাকড়ি গৃহবধূরা
ফুলবাড়ীতে এসিল্যান্ডের সরকারি মোবাইল ফোন নম্বর ক্লোন চাঁদা দাবি: থানায় জিডি দায়ের
ফুলবাড়ীতে সবজির দাম উর্ধ্বমূখী রাতারাতি দাম বাড়ায় ক্ষুব্ধ ভোক্তা
ধর্মপাশায় সরকারি রাস্তার গাছ কেটে নিলো এক শিক্ষক
সাঈদীর মৃত্যু নিয়ে ফেসবুকে ষ্ট্যাটাস দেয়ায় রামগঞ্জে ছাত্রলীগ নেতা বহিস্কার
বিয়ের দাবিতে প্রেমিকের বাড়ীতে অনশন
মসিকে ১০ কোটি টাকার সড়ক ও ড্রেনের কাজ উদ্বোধন করলেন মেয়র
কলমাকান্দায় নদীর পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু
বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী বাঁশ-বেত শিল্প
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক যতীন সরকারের জন্মদিন উদযাপন
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ যতীন সরকারের ৮৮তম জন্মদিন আজ
১ বিলিয়ন ডলার নিয়ে এমএলএম mtfe বন্ধ
কলমাকান্দায় পুলিশের কাছে ধরা পড়লো তিন মাদক কারবারি
আটপাড়ায় জিপিএ-৫ প্রাপ্ত ১০৩ জন কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা
নকলায় ফাঁসিতে ঝুলে নেশাগ্রস্থ কিশোরের আত্মহত্যা
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ নুরুল ইসলামের রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস
কলমাকান্দায় আগুনে পুড়ে ২১ দোকানঘর ছাই

Notice: Undefined variable: sAddThis in /home/durjoyba/public_html/details.php on line 809