শিল্পী প্রদীপ কুমার পন্ডিত
বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতার শিল্পী প্রদীপ কুমার পন্ডিত শুদ্ধ সংগীত চর্চা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে গড়ে তুলেছেন নিজ বাসায় সা-রে-গা-মা সংগীত বিদ্যালয়। এছাড়াও বর্তমানে মদন শিল্পকলা একাডেমি ও নান্দাইল কিরণ স্মৃতি সংগীত বিদ্যালয় এবং রোয়াইলবাড়ীতে প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের গড়া শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠে সংগীত প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন।
তিনি নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার কান্দিউড়া ইউনিয়নের তেঁতলিয়া গ্রামের স্বর্গীয় প্রফুল্ল চন্দ্র পন্ডিত ও স্বর্গীয়া বাসন্তী রানী পন্ডিতের ঔরসজাত সন্তান। এক বোন, তিন ভাই এর মধ্যে প্রদীপ পন্ডিত সবার ছোট ।
ছোটবেলা থেকেই নিজ দাদা ও মা-বাবার কন্ঠে গান শুনতে শুনতে গান শেখার প্রতি প্রবল আগ্রহ কাজ করে। দাদা স্বর্গীয় প্রভাত চন্দ্র পন্ডিত খুব ভালো কীর্ত্তন করতেন। তাঁর মাতা ধর্মীয় পাঁচালী পাঠে ছিলেন খুবই পারদর্শী। মূলত মায়ের আগ্রহেই প্রদীপ কুমার পন্ডিতের গানের জীবনে আগমন ঘটে। বলা যায়,পরিবারগত ভাবে এ শিল্পীর রক্তে গান আছে।
তেঁতুলিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত ও সাজিউড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন কিশোরগঞ্জ হাসমত উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে ১৯৮৩ সনে তিনি মেট্রিক পাশ করেন।কিশোরগঞ্জ গুরু দয়াল কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা শুরু করার পাশাপাশি ভর্তি হন জেলা শিল্প কলা একাডেমীতে। সেখানে মাসির বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করা কালীন সময়ে মসাতো ভাই-বোনদের একজন উস্তাদ বাসায় এসে গানের তালিম দিত। তখন তিনি শুধু মন মুগ্ধ হয়ে শুনতেন । মসাতো ভাই ছিলেন ভালো তবল বাদক। উনার কাছেই প্রথম তবলায় হাতে খড়ি হয় শিল্পী প্রদীপ পন্ডিতের।
সেই থেকে কিশোরগঞ্জ শিল্প কলা একাডেমীর সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে পড়েন। দেশের বিভিন্ন শিল্পীদের সাথে দীর্ঘ কয়েক বছর তবলা বাজানোর পর সংগীতের প্রতি ঝুকে পড়েন এবং উস্তাদ নিখিল রঞ্জন নাথ টুক্কুর কাছে রবীন্দ্র সংগীতের তালিম নেন এবং উস্তাদ বিনয় কর রায়,উস্তাদ পরেশ ভট্টাচার্য ও ভারতে উস্তাদ প্রীতি নাথ জোয়ার্দারের কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম গ্রহন করেন।
সংগীতে এম মিউজ করার লক্ষ্যে রবীন্দ্র বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য নিখিল বঙ্গীয় সংগীত একাডেমী থেকে বি মিউজ করেন । বিধি,বাম হওয়ায় বাবার মৃত্যুর কারণে দেশে ফিরে আসেন, এম মিউজ আর করা হলো না ।
তখনকার সময়ে তিনি আধুনিক বাংলা ও ছায়াছবির গান করতেন। অবশ্য এর পূর্বে স্কুলে পড়াকালীন সময়ে স্কুলে যাওয়া –আসার সময়ে রাস্তার মাঝেই গান গেয়ে উঠতেন। একদিন ক্লাসে গান গাইতে বললে তিনি লজ্জায় গাইতে না পারার কারণে শ্রেণী শিক্ষক তাকে প্রহার করেন। তখন তিনি মনে মনে জেদ ধরেন একদিন তিনি বড় শিল্পী হবেন।
পরবর্তীতে বিদ্যালয়ের বিদায় অনুষ্ঠানে একটি মনের দাম দিতে গিয়ে গানটি গেয়ে ব্যাপক সুনাম ও প্রশংসা কুঁড়ায়।লেখাপড়ার পাশাপাশি ১৯৮৬ সনে পুনরায় তিনি কেন্দুয়া চলে আসেন এবং স্থানীয় সংগীত শিল্পীদের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে ১৯৮৯ সনে গড়ে তোলেন কেন্দুয়া ঝংকার শিল্পী গোষ্ঠি।শিল্পী প্রদীপ কুমার পন্ডিতের কন্ঠে ২০০৭ সালে শাহ্ আব্দুল করিমের কেন পিরীতি বাড়াইলায় রে- গানটি সিডি আকারে দি লন্ডন আন্ডার গ্রাউন্ডের মিউজিকে বাজারে বের হয়। ২০১০ সালে সোহেল আরমান পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক এইতো প্রেম ছবিতে বাংলার এ,আর রহমান খ্যাত শিল্পী হাবীব এর কম্পোজে জনপ্রিয় হৃদয়ে আমার বাংলাদেশ গানটিতে হাবীব,আরেফিন রুমি ও প্রদীপ পন্ডিত মিলে কণ্ঠ দিয়েছেন। যা বিগত ৪০ বছর পর একটি দেশের গান, এত জনপ্রিয় হয়েছে ।
প্রায় ৪০/৪২ বছরের সংগীত জীবনে মান্নাদের সঙ্গে ৫/৬ বার সাক্ষাত লাভ করে আর্শীবাদ প্রাপ্ত হয়। শুধু মাত্র ক্যাসেটের গান শুনে মান্না দে কে ক্যাসেট গুরু হিসেবে হৃদয়ে ধারণ করেন। মান্না দে এর মৃত্যুর পর শোকে শোকাবিভূত হয়ে তিনি মাথা ন্যাড়া করেন। যা কিনা একমাত্র পিতা মাতা মৃত্যুর পর সন্তানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এতে প্রতীয়মান হয় মান্না দে কে তিনি উস্তাদ ও পিতৃজ্ঞানে ভক্তি শ্রদ্ধা করতেন। জীবনে তিনি ২ কন্যা সন্তানের জনক।
এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ৫ শতাধিক মঞ্চে সংগীত পরিবেশন করেছেন। বি,এস,এস ও বি,এড পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন তিনি। কলকাতায় প্রায় ১০ বছর অতিবাহিত করেছেন সংগীত শিক্ষার জন্য। সেখানে তিনি বিভিন্ন উস্তাদের নিকট উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নেন। এমনকি কলকাতার বিভিন্ন সংগীত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করে। কলকাতা থেকে পুনরায় ফিরে আসেন বাংলাদেশে।
১৯৯১ সনে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে জাতীয় পর্যায়ে নজরুল সংগীতে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন। ১৯৯৮ সনে বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে আধুনিক ও নজরুল সংগীতে তালিকা ভুক্তি শিল্পীর অর্ন্তভুক্ত হন। এখন পর্যন্ত নিয়মিত বিশেষ শ্রেণীর শিল্পী হিসেবে গান করে যাচ্ছেন।
কন্ঠ শিল্পী হিসেবে গান গাওয়ার পাশাপাশি তিনি ৪০/৫০ টি গান রচনা করেছেন। তাঁর রচিত গানগুলো এ প্রজন্মের শিল্পীরা বেতার ও টেলিভিশনে পরিবেশন করে আসছে।
এ শিল্পীর সাথে আলাপকালে তিনি আরও বলেন শুদ্ধ সংগীত চর্চা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। সংগীত গুরুমূখী বিদ্যা। গুরু ছাড়া সংগীত পূর্ণ হয় না । সংগীতের মুলধারা হলো উচ্চাঙ্গ সংগীত । গুরুর আদেশ উপদেশ মেনে সঠিক ভাবে উচ্চাঙ্গ সংগীতের চেষ্টা অব্যাহত রাখলে অভিজ্ঞতার পাশাপাশি গায়কী শ্রুতিমধুর হয় ।এর জন্য ভক্তি শ্রদ্ধা আবশ্যক । নতুন প্রজন্মের সংগীত শিক্ষার্থীদের কে উচ্চাঙ্গ সংগীত চর্চা করতে বলেন ।
এজন্য নিজ বাসায় সা-রে -গা-মা সংগীত বিদ্যালয় গড়ে তুলেছি। এতে ২০/২৫ জন সঙ্গীত শিক্ষার্থী আছে । এ কার্যক্রম বর্তমানে অব্যাহত রয়েছে ।
আরও পড়ুন: একজন দিলবাহার খান ও কিছু কথা