
গাইনের গীত
ময়মনসিংহের গ্রামাঞ্চলে-বিশেষ করে পূর্ব ময়মনসিংহের নেত্রকোণার গ্রামগুলোতে এক সময় 'গাইনের গীত'এর খুব প্রচলন ছিল। গাইনের গীত পরিবেশনকারীর প্রধান যিনি তাকে গীতালু বা গাজীর গাইন বলা হতো। কালক্রমে এক সময় তাদের নামের পাশে বয়াতি উপাধি যুক্ত হয়। যে কারণে বর্তমান গাইনের গীত পরিবেশনকারীকে এখন অনেকেই বয়াতি বলে অবহিত করেন।
'গাইন' অর্থ গায়ক বা গাইয়া। এদের বৈচিত্র পোশাক,লম্বা চুল,গলায় তসবিহ ও মালা,হাতে একটি আশা নিয়ে ৩/৪জনের একটি দল গ্রামে গ্রামে গিয়ে গাজীর গীত পরিবেশন করেন। তাদের আশা'টির অগ্রভাগ ত্রিশূলের মত। এর মাথায় একটি অর্ধচন্দ্র খচিত লোহার দন্ড এবং গীতালুর হাতে একটি লোমশ জাতিয় চামর থাকে। আসরে ত্রিশূল কুপে ত্রিশূলের উপর অনেক গুলো তসবিহ ও মালা জড়িয়ে রাখা হয়। মূল গায়েনের সাথে সামান্য বাদ্যযন্ত্র যেমন- ঢোল মন্দিরা,চইট্টাসহ দুই তিন জনের গায়ক বাদ্যকর নিয় গাইনের গীতের দল গ্রামাঞ্চলে মানত/মানসিক কিম্বা গৃহস্থের মঙ্গলকামনায় গাওয়ানো গাইনের গীত পরিবেশন করে থাকেন। আসরের জন্য নির্ধারিত খুব বড় জায়গার প্রয়োজন হয় না। কোন বাড়ির আঙ্গিনায়, গাছতলায় বা গৃহস্থ বাড়ির উঠানে রাত বা দিনের বেলায়ও গীতের আসর বসানো হয়।
মূলত গাজীপীর ও কালুপীরের জীবন কাহিনীকে পালায় রূপান্তর করে কথা ও সুর গীতে গাওয়া হয় বলে মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেকেই পরিবারের মঙ্গল কামনায় ও রোগ-বালাই,মসিবত দূরিকরণের লক্ষ্যে মানত বা মানসিক করে গাজীর গীত গাওয়ানো হয়। সে কারণে একে বিশেষ মর্যাদার সাথে পরিবেশন করা হয়। গীতালু বা গাইন কাব্যে-ছন্দে,কথা ও সুরে গেয়ে শ্রুতাদের একটি ঘোরের মধ্যে নিয়ে যান।শ্রুতাগণ মোহিত হয়ে রাতভর শুনেন গাজীর পালা।গীতালু দলকে মানতকারী বা আয়োজকগণ চাল-ডাল,নতুন কাপড়, ও টাকা পয়সা দিয়ে তুষ্ট করেন।
আবার গাইনের গীতের দলকে দিনের বেলায় গ্রামে ঘুরে গৃহস্থ বাড়ির কর্তি ও বৌ-ঝিদের নানা উপদেশ মূলক কথা সুরের মিশ্রণে বিমোহিত করে চাল ডাল,টাকা পয়সা হাদিয়া বা শিন্নি গ্রহন করতে দেখা যায়। গীতালু ছন্দ কথায় যা আবৃত্তি করেন তার কিছু নমুনা নিম্নে দেওয়ার চেষ্টা করছি।
* থম থমাইয়া হাঁটে নারী চোখ পাকাইয়া চায়,সেই নারীরে করলে বিয়া আয়ূ থাকতে স্বামী যমে লইয়া যায়।
* উট কপাইল্যা চিরল দাঁতি ফিঙল মাথার কেশ,সেই নারীরে করলে বিয়া ঘুরবে নানান দেশ।
* সইন্ধা বেলা যে বা নারী হরিদ্রা বিলায়,হাঞ্জু বছর রাঢ়ি হইয়া বাপের বাড়িত যায়।
* রাইন্দা বাইরা যে বা নারী পুষ্যের আগে খায়, ছয় মাসের আয়ূ থাকতে স্বামী যমে লইয়া যায়।
* নয়া কাপড় পিন্দ্যা নারী পিছন ফিইরা চায়,লক্ষি মায়ে ছাইড়া যায় আর ফিইরা ফিইরা চায়।
* সইন্ধা বেলা যে বা নারী ঘরে না দেয় বাত্তি, লক্ষি মায়ে উইঠ্যা কয় তোর কপালে দিলাম লাত্তি।
* উঠান ফুইরা যে বা নারী দক্ষিনে দেয় পারা, ছাইড়া যাইতে লক্ষি মায়ে সীমানায় থাকে খাড়া।
* উগাড়ে উইঠ্যা যে বা নারী বড় রাও করে, লক্ষিদেবী উইঠ্যা বলে শেল মারছে অন্তরে।
* গোসল কইরা যে বা নারী কাপড় চিপে পায়,হাতে ধইরা চৌদ্দ পুরুষ নরকে ডুবায়।
* গোয়াল ঘরে যে বা নারী ভাজা পোড়া খায়, সেই গোয়ালের পরধান গরু আত্কা মইরা যায়।
* রাইন্দা বাইরা যে বা নারী মুখে দেয় গো পান, লক্ষিদেবী উইঠ্যা বলে তুই অলক্ষির সমান।
* ভরা হইতে উনা ভালো যদি ভরতে যায়,আগে থাইকা পাছে ভালো যদি ডাকে মায়।
* সতী নারীর পতি জানো মসজিদেরই চূড়া,বেশ্যা নারীর পতি যেনো ভাঙ্গা নায়ের গুড়া।
ইত্যাদি কথনে উঠান জমানো হতো গীতের আসর।
গাইনের মুখের এমন কথা গুলোর অধিকাংশই নারীর বিপক্ষে যায়,কিন্তু নারীগণ এ গুলোকে হিতপোদেশ মনে করতেন। এ সমস্ত গীত- কথা শুনে গৃহস্থ নারীগণ গাইনকে চাল,ডাল,ফল,সবজির সাথে টাকা পয়সা দক্ষিণা হিসেবে দিয়ে থাকেন। গাইন খুশি হয়ে হাতের আশা,ত্রিশূল বা লোমশ চামর তার মাথায় ছুঁয়ে দিয়ে আশির্বাদ করে অন্য বাড়ির পথে পা বাড়ান। এই ভাবেই চলতো মাসের পর মাস গাইনের গীত। গাইনের গীত পরিবেশন প্রায় বিলুপ্ত হলেও নেত্রকোণার কোন কোন অঞ্চলে এখনও আব্দুল জব্বার বয়াতি,মনসুর বয়াতি,পাঞ্জু বয়াতিদের মতোর গীতালুরা অনেকেই গাইনের গীত পরিবেশন করে জীবিকা নির্বাহ করে চলেছেন।
আরও পড়ুন: কিচ্ছা বলার গ্রমীণ বৈঠক