সিলেটে অসহায় এক মাকে ফাঁসালেন আইনজীবী
ছেলে রায়হান কিডনি রোগে আক্রান্ত। কিন্তু দরিদ্র মা জেসমিন বেগমের (৩৫) ছেলের চিকিৎসার ব্যয় বহনের সামর্থ্য নেই। বাসাবাড়িতে কাজ করে আর মানুষের কাছে চেয়েচিন্তে কোনোমতে সংসার চালান, ছেলের চিকিৎসার টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করেন।
তাঁর এই অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে এক আইনজীবী তাঁকে টাকার বিনিময়ে আদালতে ভুয়া সাক্ষ্য দেওয়ার প্রস্তাব দেন। সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে জেসমিন আদালতে যান। কিন্তু সেখানে তাঁকে মামলার আসামি হিসেবে উপস্থাপন করেন আইনজীবী। আদালতও জেসমিনকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
ঘটনাটি ঘটেছে সিলেটের যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ প্রথম আদালতে, গত বুধবার। আদালত সূত্র বলেছে, যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ প্রথম আদালতের বিচারক মোহাম্মদ দিদার হোসাইনের আদালতে দুটি চেক ডিজঅনার মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি নাজনীন সুলতানা সেজে হাজিরা দিতে এসে ধরা পড়েন জেসমিন। এ ঘটনায় জেসমিন ও নাজনীনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তবে জেসমিনকে যিনি নাজনীন সাজিয়ে আদালতে হাজির করেছিলেন, সেই আইনজীবী হানিফ উদ্দিনকে নতুন মামলায় আসামি করা হয়নি।
জেসমিন গত বৃহস্পতিবার সিলেট মহানগর হাকিম-১ মো. সুমন ভুঁইয়ার আদালতে ১৪৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তিনি হবিগঞ্জের বানিয়াচং থানার সিকান্দারপুরের মৃত হান্দু মিয়ার মেয়ে। বর্তমানে সিলেট নগরের শাহি ঈদগাহের বড়বাড়ির (সালাম মিয়ার কলোনি) বাসিন্দা। নাজনীন সুলতানা সিলেট নগরের নয়া সড়ক এলাকার মোস্তাফিজুর রহমানের স্ত্রী।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে জেসমিন বলেন, তিনি মানুষের বাসায় কাজ করেন। অ্যাডভোকেট হানিফ উদ্দিন তাঁর পরিচিত। তাঁর বাসায় দুদিন কাজও করেছেন তিনি। তবে জেসমিনের বাসা থেকে হানিফ উদ্দিনের বাসা দূরে হওয়ায় কাজটি ছেড়ে দেন। গত মঙ্গলবার শাহি ঈদগাহ কাঁচাবাজারে হানিফ উদ্দিনকে পেয়ে ছেলে রায়হানের চিকিৎসার জন্য কিছু সাহায্য চান জেসমিন। কিডনি রোগে আক্রান্ত রায়হানকে এর আগে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তিও করাতে হয়েছে। সাহায্য চাইলে অ্যাডভোকেট হানিফ জেসমিনকে আদালতে গিয়ে একটি জমির মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার প্রস্তাব দেন, বিনিময়ে রায়হানের চিকিৎসার ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেন।
জেসমিন প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। বুধবার অ্যাডভোকেট হানিফের সঙ্গে তিনি আদালতে যান। সেখানে কোনো কিছু না বলেই জেসমিনকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে অ্যাডভোকেট হানিফ তাঁকে আসামি হিসেবে উপস্থাপন করেন। শুনানি শেষ করে আদালতের বিচারক জেসমিনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট হানিফকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জেসমিনকে ‘আসতেছি’ বলে কেটে পড়েন।
জবানবন্দিতে জেসমিন আরও বলেন, পুলিশ তাঁকে আদালত থেকে বের করে চত্বরে অন্য আসামিদের সঙ্গে রাখে। সে সময় তিনি পুলিশকে জানান, তিনি কোনো মামলার আসামি নন, ভুয়া সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন। পুলিশ তাঁকে আবার বিচারকের কাছে নিয়ে যায়। এরপর বিচারক তাঁকে আবারও কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। পরে তাঁকে কোতোয়ালি থানায় নেওয়া হয়।
আদালতের এপিপি অ্যাডভোকেট শাবানা ইসলাম গতকাল শুক্রবার রাতে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘নাজনীন সুলতানা নামের সাজাপ্রাপ্ত এক আসামি দুটি মামলায় পলাতক ছিলেন। কিছুদিন আগে রায় হওয়া মামলায় আদালত জামিন দিলেও ২০১৯ সালের মামলায়ও পলাতক থাকায় সেটির জামিন আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তখনই ওই মহিলা জানান, কিছু টাকা দেওয়ার কথা বলে আইনজীবী তাঁকে একটি মামলায় সাক্ষ্য দিতে নিয়ে এসেছেন। ওই নারী নাজনীন সুলতানা নন, তিনি জেসমিন বেগম। পরে আদালত এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা দায়েরের জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেন।’
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মাদ আলী মাহমুদ বলেন, ‘আদালতের নির্দেশে মামলা হয়েছে। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কোতোয়ালি থানার বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই কল্লোল গোস্বামীকে। শুনেছি, ওই নারী (জেসমিন) ১৪৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে কী বলেছেন, জানি না।’
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে অ্যাডভোকেট হানিফ উদ্দিনের ব্যবহৃত তিনটি মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার কল করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। খুদে বার্তারও কোনো জবাব দেননি তিনি।
আজকের পত্রিকা