সিএনজি স্ক্র্যাপকরণে ঘুষ বাণিজ্যের মহোৎসব
বাংলাদেশ রোডস ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) চট্টগ্রাম কার্যালয় দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
নানা অনিয়ম ও মোটা অংকের ঘুষ বানিজ্যের মহোৎসব এর মধ্য দিয়ে সম্প্রতি চট্টগ্রামে মেয়াদোত্তীর্ণ সিএনজি অটোরিকশা স্ক্র্যাপ কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ রোড ট্র্যন্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) চট্টগ্রাম মেট্টো অফিস। কৌশলে দালালের মাধ্যমে গাড়ি প্রতি ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করেছে শুধুমাত্র স্ক্র্যাপ করতে। প্রতিস্থাপন করতে আরো ৪৫ হাজার টাকা লাগবে বলেও জানা গেছে। চাহিদা মোতাবেক ঘুস প্রদান না করায় নানা অযুহাতে প্রকৃত মালিকদের হয়রানি করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলছেন একাধিক মালিক। ঘুসের টাকা দিতে না পারায় কিছু মালিকের গাড়ি স্ক্র্যাপ করা হয়নি। অবশ্য ঘুষ বাণিজ্যের কথা অস্বীকার করছে বিআরটিএ’র দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।
জানা যায়, গত ২৬ মে চট্টগ্রাম মহানগরীর হালিশহরস্থ বিআরটিএ কার্যালয়ে মেয়াদোআত্তীর্ণ সিএনজি স্ক্র্যাপ করার নামে মালিকদের কাছ থেকে মোটা অংকের ঘুস আদায় করা হয়েছে। বিআরটিএ’র নির্ধারিত দালালদের মাধ্যমে যারা চুক্তি মুল্য পরিশোধ করেছেন, তাদের সকল মুশকিল মুহুর্তেই আহসান হয়েছে। এমনকি গ্রামের সিএনজিও ভাঙ্গার জন্য আনা হয়ছে বলে জানা গেছে। তবে গাড়িটি ফেরৎ যায়নি বলে একটি বিশ্বস্ত সুত্র জানিয়েছে।
অপর একটি সুত্র জানায় স্ক্র্যাপকরণে পেপারে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগেই বিভন্ন গাড়ির মালিকদের সাথে কন্ট্রাক্ট করতে থাকে। আবার অনেকে মোটা অংকের টাকা খরচের ভয় দেখিয়ে গাড়ি কিনে নিয়ে তাদের গ্যারেজে নিয়ে আসে বিআরটিএ’র নির্ধারিত দালাল চক্র। এই চক্রের মাধ্যমেই অনৈতিক লেনদেন হয়েছে বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন মালিক জানান, কন্ট্রাক্ট ছাড়া একটি গাড়িও ভাঙা হয়নি। আপনি কত টাকায় কন্ট্রাক্ট করেছেন জানতে চাইলে টাকার অংক না বললেও মৌখিক চুক্তির বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
হাটহাজারির তপন চন্দ্র নাথ নামের এক মালিক জানান, তার গাড়ির সকল কাগজপত্র ঠিক থাকার পরেও ৮/১০ জনে মিলে তাকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে, কেন বের করে দিচ্ছে তাও জানতে পারেননি তিনি। তিনি বলেন আমার গাড়ি স্মার্ট কার্ড, ডিজিটাল মিটারসহ যাবতীয় ডকুমেন্টস আছে, তবু তার উপর জুলুম করা হয়েছে এবং এই অপরাধের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বয়স্ক আরো একজন মালিক জানিয়েছেন, তার কাছে দালালরা প্রথমে ৭ লাখ টাকা দাবি করলেও পরে ৬ লাখ টাকা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। টাকা দিতে না পারায় তাঁর গাড়ির সকল কাগজপত্র ঠিক থাকার পরেও গাড়ি স্ক্র্যাপ না করে তাকে বের করে দেয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শহর এলাকায় বসবাসকারী একজন মালিক জানান তার গাড়ির সকল কাগজপত্র ঠিক থাকার পরেও ডবল মালিকের অযুহাত দেখিয়ে গাড়ি ভাঙতে অপারগতা প্রকাশ করেন উপপরিচালক তৌহিদুল হোসেন, তবে ২য় কোন মালিককেই প্রকাশ্যে আনতে পারেনি কেউ। তিনি বলেন ডবল মালিক একটা অযুহাত মাত্র। আমি যদি উনার সাথে (উপপরিচালক তৌহিদুল হোসেন) বা তাদের সিন্ডিকেটের সাথে ৫/৭ লাখ টাকায় কন্ট্রাক্ট করি তাহলে কাগজপত্রও দেখবে না। আমি কন্ট্রাক্ট না করায় আমাকে হয়রানি করার জন্য উছিলা তৈরি করছে। ঘুসের টাকা যোগার করতে না পারায় গাড়ি নিয়ে বিআরটিএ’র মাঠেও যাননি অক্সিজেন এলাকার ২০০২ মডেলের একজন মালিক। তিনি জানান বিআরটিএর উপপরিচালক তোহিদুল হোসেনের কথা বলে প্রথমে আমাদের কাছে ৫ লাখ টাকা দাবি করা হয় আমরা এতো টাকা দিতে পারবনা জানালে ৩ লাখ টাকার নিচে হবেনা বলে জানান ইমরান নামের এক দালাল। তিনি বলেন আগেরবার যখন গাড়ি স্ক্র্যাপ করা হয়েছিল তখনও ১ লাখ টাকা দাবি করা হয়েছিল, সেই টাকা দিতে না পারায় তখন আর স্ক্র্যাপ করেনি। তবে এখন আর স্ক্র্যাপ করার সুযোগ নেই জানিয়ে একাধিক দালালেরা গাড়িটি কেনার জন্য চেষ্টা করছে।
ঘুষ আদায় ও মালিকদের হয়রানির বিষয়টি অস্বীকার করে মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস/ পেট্রোলচালিত ফোর স্ট্রোক থ্রি-হুইলার অটোরিক্সা স্ক্র্যাপ কমিটি চট্টগ্রাম অঞ্চলের আহবায়ক ও বাংলাদেশ রোড ট্র্যান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) চট্টগ্রাম মেট্রো সার্কেল ১ এর উপপরিচালক তৌহিদুল হোসেন বলেন, কউ যাতে ভোগান্তির মধ্যে না পড়েন সেজন্য নিয়ম মেনে বিআরটিএ কার্যালয়ের সামনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং বিআরটিএ’র উর্ব্ধতন কর্মকর্তার উপস্থিতিতেই ১৫১ টি অটোরিকশাগুলো পর্যায়ক্রমে স্ক্র্যাপ করা হয়েছে। এর ফলে চট্টগ্রামে আর কোন মেয়াদোত্তীর্ণ সিএনজি থাকলনা।এতে কোনো অনিয়ম বা ভোগান্তিও হয়নি। যারা এসব অপপ্রচার করছে তারা আমাদের স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে নানাভাবে চক্রান্ত করছে। তিনি বলেন, গত ২৩ মে পত্রিকায় ২০০১, ২০০২, ২০০৩, ২০০৪ ও ২০০৫ সালে তৈরিকৃত সিএনজি চালিত অটোরিক্সা স্ক্র্যাপকরণের বিজ্ঞপ্তি জারি করে। ফলে যেসব সিএনজি মালিকরা এসব মেয়াদোত্তীর্ণ সিএনজি স্ক্র্যাপকরণের জন্য বিআরটিএ’ কার্যালয়ে তালিকাভুক্ত করেছেন সেগুলোই স্ক্র্যাপ করা হয়েছে। এর আগে ২০০১ সাল থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে ১৩ হাজার করে ২৬ হাজার সিএনজি অটোরিকশা নিবন্ধন দিয়েছিল বিআরটিএ।
চট্টগ্রাম বিভাগের বিআরটিএর পরিচালক (প্রকৌশল) মোহাম্মদ শফিকুজামান ভুঞা সকল অনিয়ম ঘুস বাণিজ্যের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, কেউ ঘুস দিয়েছে বা না দেয়ার ফলে হয়রানির শিকার হয়েছে এমন কোন অভিযোগ পাইনি। যদি কেউ অভিযোগ করে তবে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এব্যপারে স্ক্র্যাপ কার্যক্রমে উপস্থিত থাকা বিআরএি’র পরিচালক (প্রশিক্ষণ) মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমার জানাতে ঘুসের লেনদেন হয়েছে এমন কোন অভিযোগ পাইনি। নিয়ম মেনে বিআরটিএ কার্যালয়ের সামনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে স্ক্র্যাপ করা হয়েছে। আমি অনেককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ঘুস ও হয়রানির কোন অভিযোগ আছে কিনা। কিন্তু আমার কাছে কেউ এমন তথ্য উপস্থাপন করেনি।
উল্লেখ্য বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির-(বিআরটিএ) হালিশহরস্থ চট্টগ্রাম মেট্রো সার্কেল ১ এর কার্যালয়ে গত শুক্রবার (২৬ মে) দেড় শতাধিক সিএনজি চালিত অটোরিক্সা স্ত্র্যাপকরণ করেছে। সময় উপস্থিত ছিলেন বিআরটিএ ঢাকার প্রধান কার্যালয়ের পরিচালক (প্রশিক্ষণ) সিরাজুল ইসলাম, চট্টগ্রামের বিভাগীয় পরিচালক (প্রকৌশল) মোহাম্মদ শফিকুজামান ভুঞা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. কামরুল ও চট্টমেট্রো-১ সার্কেলের উপ-পরিচালক তৌহিদুল হোসেনসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রাম বিআরটিএ দুর্নীতির নিউজ ১ ধারাবাহিক চলমান থাকবে.....
আরও পড়ুন: র্যাবের হাতে ২ কোটি টাকার হেরোইনসহ এক নারী মাদক ব্যবসায়ী আটক