![ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী : আমাদের ‘সক্রেটিস’ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী : আমাদের ‘সক্রেটিস’](https://www.durjoybangla.com/media/imgAll/2023April/Zafrullah-Chowdhury-2304210459.jpg)
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী
বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মারা গেলেন ১১ এপ্রিল ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ মঙ্গলবার রাত ১০.৪৫ মিনিটে। জাতীয় বীরের মহাপ্রয়াণে বিনম্র শ্রদ্ধা। ১৪২৯ বাংলার চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন বিদায় নিলেন এ মহাপ্রাণ। রেখে গেলেন তার কীর্তিচিহ্ন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র আর অগণিত মানুষের ভালোবাসা। রেখে গেলেন, ড. বিজন কুমার শীলের ভাষায়, ‘এক জীবনে বহু জীবনের সমান হওয়ার গল্প’।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ডা. মামুন মোস্তাফী মৃত্যু ঘোষণায় বলেন, ‘অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আপনাদের জানাচ্ছি, আমাদের প্রিয় বড় ভাই আমাদের মাঝে আর নেই।’
সবকিছু ছাপিয়ে বড় ভাই। ৮২ বছরের বড়ভাই। মুক্তিযোদ্ধা বড় ভাই। দশ ভাই বোনের বড় ভাই। ডাক্তারদের বড় ভাই। রাজনীতিবিদদের বড় ভাই। আন্দোলনরত ছাত্রদের বড় ভাই। রেলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো একলা রনির সহায় বড় ভাই। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিটি কর্মীর বড় ভাই। হিন্দী সিনেমার গল্পের মুন্না ভাই এমবিবিএস নয়। গল্পের চেয়েও বড়, আপামর শোষিত মানুষের বড় ভাই।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গবেষক ড. বিজন কুমার শীলের সহজ সরল স্বীকার, লোকটাকে দেখলেই স্যার ডাকতে ইচ্ছে হতো। এই স্যার সুবিধা আদায়ের স্যার নয়। এই স্যার জিহ্বা টেনে ধরে ডাকানো স্যার নয়। এ স্যার ডাক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় অবনত হওয়া ডাক। বঙ্গবন্ধুর গুডবুকে থাকা নাম হীরা না হয়ে পারে না, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তার প্রমাণ। যে নেতার নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, যে নেতার দেওয়া নামে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়েছেন, তার আদর্শ লালন করেছেন, নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেননি।
ব্ল্যাংক চেকের লোভ দেখিয়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে মন্ত্রী বানানো যায়নি। নতুন প্রজন্ম জানো এটা বাংলাদেশে সম্ভব। এটা একমাত্র ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর পক্ষে সম্ভব। তাইতো আজ মৃত্যুর পর কে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। কেউ বলছে স্যার, কেউ বলছে নেতা, কেউ বলছে শিক্ষক কেউ বলছে আমাদের বটবৃক্ষ। চোখের মণি হারিয়ে চোখের জলে ভাসছে, শহীদ মিনারে কতজন। কেউ বলছে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী হয়ে উঠেছিলেন জাতির বিবেক। তবে আমাদের বিবেক মৃতই থাকে আর মৃত্যুর পরে শুধু জাগে না উঠে বসে দৌড়ায়।
নচিকেতা গান গায়, ডাক্তার মানুষ নয় সেতো ভগবান। কিন্তু ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ভগবানের জীবন বেছে নেননি। লন্ডনের রয়েল জীবন বেছে নেননি জমিদার নন্দন। বেছে নিয়েছিলেন যোদ্ধার জীবন। শরীরের বয়স বেড়েছে কিন্তু মনের বয়স বাড়েনি। ১৯৭১ সালে যে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন আমৃত্যু লড়ে গেছেন থামেননি। থামার সুযোগই পাননি। মানুষের ক্রন্দন যে থামে না। এক মানুষ কাঁদলে আরেক মানুষ হাসে। সব মানুষ একসঙ্গে হাসতে বা কাঁদতে পারে না। একজনের ক্রন্দন অন্যজনের মুখে হাসি এনে দেয়। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মত লোক বরাবরই নিপীড়তদের দলে ছিলেন। ফুলের জলসায় যাননি কখনো। হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন দুঃখ মোছানোর কাজ। আজ তাই বাংলাদেশের ভেতর থেকে বেজে উঠেছে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বন্দনার গান। এত জৌলুস ভুলে ত্রিশ বছর ধরে একটি শার্ট কীভাবে পরে একজন মানুষ? কোথাও বিজ্ঞাপিত হয়নি এসব কথা। তারই প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাই বিলাপ করছে আর বলছে এসব কথা। তাদের বুক ফেটে বেরিয়ে আসছে এসব কথা আর্তনাদ হয়ে।
রুচি আর বুদ্ধি ব্যবসায়ীরা মুখ ফোটে তেমন কিছু বলছেন না। কারণ কী এমন করেছে লোকটা? যুদ্ধ সেতো অনেকেই করেছে। না লিখেছে একটা গল্প না উপন্যাস। না করেছে কাব্যবিলাস। না গড়েছে আয়নামহল। শুধুমাত্র মানুষকে ভালোবেসেই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী অমর হয়ে যাবেন?
ডাক্তারের কাছে যাওয়া মানে জমকে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা। অসুখ হলে সব মানুষই তা করে থাকে। সামর্থ্য অনুযায়ী একেক জনের একেক রকমের ডাক্তার। তাই ডাক্তারেরও শ্রেণিবিভাগ আছে। কেউ গরীবের ডাক্তার। কেউ ধনীর ডাক্তার। শ্রেণি বিভাজন আছে চিকিৎসালয়ে। গরীবের হাসপাতাল বড়লোকের হাসপাতাল। সভ্য সমাজে পশুদের হাসপাতালেও শ্রেণিবিভাজন আছে বলে জানা নেই। হাসপাতাল ব্যবহারের সঙ্গে প্রেস্টিজ ও জড়িত রয়েছে। কোন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এটা জানলে রোগীর ঠিকুঁজি খোঁজতে হবে না। হাসপাতালই নির্ধারণ করে দেবে রোগী মেয়র না পুওর।
গণস্বাস্থ্যের কর্মীরা বলেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেই রেখেছিলেন তার যত চিকিৎিসা সব হবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র যেসব সুবিধা দেশের অন্য রোগীকে দেয় সেটিই তিনি নেবেন। কারণ সারা জীবন তিনি চেষ্টা করেছেন বাংলাদেশের সকল মানুষের জন্যে নিশ্চিত করবেন চিকিৎসা সেবা। মুক্তিযুদ্ধের সেই ফিল্ড হাসপাতালকে পরিণত করেছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে। নিজ হাতে সাজিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষকে কথা দিয়েছেন আছি আমি আপনাদের পাশে। আমার যা হবে তা আপনাদেরও হবে। তাইতো এ কঠিন সিদ্ধান্ত। জীবন মৃত্যুর দোলায় চড়ে এ সিদ্ধান্ত যিনি নেন তিনি আমাদের সক্রেটিস। গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের সক্ষমতা তার নিজের হাতে গড়া। তিনি নিজে ডাক্তার। বাঁচিয়েছেন বহু মানুষের জীবন। জীবনকে তিনি ভালোবাসেন। তিনিও বাঁচতে চেয়েছেন নিশ্চই। কিন্তু যে সত্যের জন্যে আজীবন লড়াই করেছেন, তার পরীক্ষা যে দিতে হবে।
আরও উন্নত চিকিৎসা ছাড়া তিনি বাঁচতে পারবেন না এ যাত্রা। তবুও তিনি টললেন না নিজের সিদ্ধান্ত থেকে। সত্যকে আলিঙ্গন করেই পাড়ি দিলেন অমৃতলোকে। চুরি আর চামারির মহোৎসবকালে কয়জন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী পেতে পারে বাংলাদেশ? শুধু বাংলাদেশ কেন চ্যালেঞ্জ নিলাম পারলে দেখিয়ে দিক বিশ্বে এমন কে আছে শুধু নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষার্থে বরণ করবে মরণকে। সামর্থ্য আর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও গরীবদের কথা ভেবে পায়ে ঠেলবে উন্নত চিকিৎসা। সত্যিই তিনি আমাদের সক্রেটিস। মৃত্যুর হাত থেকে পালাবার সুযোগ পেয়ে ও পালালেন না। আড়াই হাজার পূর্বে প্রাচীন গ্রীসে জ্ঞানের আদিগুরু করেছিলেন একই কাজ। তবে তা ছিল ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। আড়াই হাজার বছর পরে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর লক্ষ্যও কিন্তু একটাই। সত্য প্রতিষ্ঠা করা। ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। মুখের বলা কথা সমাজে করে দেখানো। লোক দেখানো জনদরদিরা তাই আজ পরীক্ষার সম্মুখীন। যে গরীব মানুষের সমর্থনে আজ যারা খ্যাতির চূড়ায় তারা কী তাদের বলা কথা করে দেখাতে পারবেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতো?
আরও পড়ুন: বাঙালির দেবী দুর্গা
প্রাবন্ধিক