
ফুটবল বিশ্বকাপ
২০২২ সালের ১৮ই ডিসেম্বর। বিশ্বকাপ ফুটবলের ২২তম আসরের ফাইনাল হয়ে গেল। খেল খতম। চার বছর পর আবার খেলা হবে। খেলোয়াড় পরিবর্তন হবে। দল পরিবর্তন হবে। বদলাবে না একটি জিনিস। তার নাম ফুটবল। রাজনীতির খেলায় যেমন জনগণ। সব দলই কিক মারে। খেলা শেষে বল মাঠে পড়ে থাকে। বলের বোবা কান্না কেউ শোনে না। দলের কান্না বিশ্বের কানায় কোণায় পৌঁছে যায়। জাতিসংঘ নাক গলায়। বলের কান্না শোনার কেউ নেই। ফিফা বলে লাথিগুতা দেয়ার আইন বানায়। বল লাথি খেতে খেতে ফেটে গেলে ও খেলোয়াড়ের কোন শাস্তি হয় না। বল ফাটাতে পারা খেলোয়াড়ের কদরই আলাদা। এ যেন ফাটাকেষ্টো। বিজয়ী , বিজিত উভয় দলের খেলোয়াড় কোলাকুলি করে, ফুটবল মাঠের কামলা; ‘বল বয়’ নির্দয় ভাবে ফুটবলকে ঝুড়িতে ভরে। গোল শেষে, শেষ লাথিটা দিয়ে মদরিচ বলে, ফুটবল ! যা ব্যাটা ভাগ। তোর কাম শেষ। এত তাচ্ছিল্য আর ভাল লাগে না। ব্জ্জেতি হলে জনগণ কাঁদতে পারে। চেখের ফাঁক দিয়ে দু ফোটা পানি ফেলে নিজেকে হালকা করে নেয় জয়গুন। হৃদয়হীন মানব সন্তান তার জন্যে একটি ফোঁড় রেখেছে, তাও বাতাস ঢুকিয়ে বন্ধ করে দেয়।
কাতার ছোট আয়তনের দেশ হয়েও অনেক রেকর্ড বগলদাবা করে নিয়েছে। আয়োজনের বাজেটে অতিক্রম করে গেছে আগের সকল বিশ্বকাপকে। সবচেয়ে বড় কথা শরিয়ত সম্মতভাবে এত সুন্দর ফুটবল বিশ্বকাপ এ বিশ্ববাসী আর দেখতে পাবে কিনা সন্দেহ আছে। খেলা দেখতে এসে যারা খেলা দেখাতে চায় সেইসব দর্শকদের বেশ টাইট দিয়েছে কাতার। গুনাহর হাত থেকে বাঁচাবার মত কাজ করে কাতার মুসলিম উম্মা এমনকি অমুসলিমদের ধন্যবাদ পেয়েছে। ফিফা সমানতালে তাল দিয়েছে কাতারকে। এতে অনেকেই গোঁসা করেছেন। কাতার বলেছে, সমস্যা নেই। স্রেফ ফুটবল খেলা দেখতে চাইলে আসেন। কিন্তু উল্টা পাল্টা খেয়ে জন্মদিনের পোশাকে নাচবেন, এটা হবে না। কাতার ,ইতরামির স্থান দেয় না। দুবাই ফুর্তি আমোদের ব্যবস্থায় ভালোই কামিয়েছে এ সুযোগে। কাতার একবার ও লোভ করেনি। সাবাস! কাতার আল্লাহর রহমত অবশ্যই ভোগ করবে।
এখন যা বলব তাতে চোখ কেন, অনেকের অনেক কিছু কপালে উঠতে পারে। স্থানান্তরযোগ্য স্টেডিয়াম বানিয়েছে কাতার। খেলা শেষে কোন গরীব দেশকে দান করে দেবে। এমন খবর ছাপিয়ে যারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিতে চেয়েছেন তারা নোট নিতে পারেন। খেলোয়াড়ের ঘামের দাম দেয় তার দেশ। খেলার মাঠের দাম দেয় তার দেশ। কাতারও এরূপ করে আসছে এতকাল। এবার তারা টপকাবে তাবৎ দুনিয়াকে। ফেরেশ্তারা আকাশ থেকে ফুলের সুনামি পাঠাবেন কাতারের জন্যে। বুদ্ধ,যিশু, রাম কেউ বাদ যাবেন না। সবার আশীর্বাদ নেমে আসবে কাতারের মরুতে। উটের কুঁজ সমান হতে চলেছে এমন খবরে।
লুসাইল স্টেডিয়ামের প্রতিটি ঘাস অধীর হয়ে আছে খবর শোনার জন্যে। কেউ শোয়ে নেই। সবাই খাড়া। নেতিয়ে পড়লে শোনা যাবে না , অমর ঘোষণা। সুনসান নীরবতা। মাঠের লাখো মানুষের সঙ্গে, টিভি পর্দার কোটি কোটি দর্শক, ব্রাজিল আর্জেন্টিনা সাপোর্ট লড়াইয়ে নিহত লোকেদের বাংলাদেশি পরিবার, বিশ্বকাপ খেলার মাঠ নির্মাণে নিহত শ্রমিকদের পরিবার, আহত শ্রমিকের ভেজা চোখ, বন্ধ কান, আত্মহত্যার শিকার নেপালি শ্রমিক গল সিংহ রায়ের অতৃপ্ত আত্মা আরও কত। অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হচ্ছে না।
কাতারের আমির শেখ তামিম তার আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়েছেন। সবারই বুক কাঁপছে। কী করতে যাচ্ছেন আমির ? এত রেকর্ড গড়ার পরে আর কী থাকতে পারে? মাঝ মাঠে গিয়ে থামলেন শেখ। প্রিয় বিশ্ববাসী। তাজ্জ্বব কারবার বাংলায় বলছেন শেখ। নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছে না হাফিজ, মফিজ,কামাল জামাল কেউ ? বিস্ময় আরও বাড়তে লাগল। বিশ্বের যে যেখান থেকে কান পেতেছে সে তার ভাষাতেই শোনতে পাচ্ছে আমিরের বক্তৃতা না কবিতা !
আমির আবার বলতে শুরু করলেন, মহান আল্লার দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি । এ বিশাল কর্ম যজ্ঞ সমাপনে বিশ্ববাসী আপনারা সকলেই কাতারকে সহযোগিতা করেছেন । কাতার আপনাদের কাছে ঋণী । আমি কাতারের জনগণের পক্ষ থেকে আপনাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি । আমি কাতারবাসীর পক্ষ হতে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি , সেই সব শ্রমিক ভাইদের যারা তাদের শ্রমে ঘামে আমাদের এই অর্জনকে সফল করেছেন । প্রিয় বিশ্ববাসী , নিয়মের দুনিয়ায় অনেক অনিয়ম হয় । আমরাও অনেক অনিয়ম করেছি । অনেক গুনাহ করেছি। আপনাদের মহব্বতে আল্লাহ আমাদের ফানাহ দিবেন। আমরা অকপটে আমাদের ভুলগুলো আজ স্বীকার করব। আমরা স্বপ্ন দেখিয়ে বিশ্বের যে সব দেশ থেকে শ্রমিক সংগ্রহ করেছি, তাদের সঠিক তালিকা সবার সামনে প্রকাশ করব। আমাদের ভুলের কারণে যাদের মৃত্যু ঘটেছে তাদের সঠিক সংখ্যা ও নাম প্রকাশ করব। আমাদের দেয়া মানসিক যন্ত্রণায় যারা আত্মহত্যা করেছেন তাদের পরিবারের কাছে মাফ চাইব। কারণ তারা আমাদের ক্ষমা না করলে আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করবেন না। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে জোর করে যাদের দিয়ে কাজ করিয়েছি, এদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের রূহের কাছে মাফ চাইছি। তাদের পরিবারের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইছি। আমরা আমাদের সাধ্যমত আর্থিক সহযোগিতার অঙ্গীকার করছি। আমরা আল্লাহকে ভয় পাই। আল্লাহর প্রিয় বান্দা আমাদের কাছ থেকে দুঃখ পেয়ে পৃথিবী ছেড়েছেন। আমরা কাতারবাসী কখনই এটা মেনে নিতে পারি না। আমরা কোন তথাকথিত মানবাধিকার সংস্থার মত কাজ করতে চাই না। আমরা হাঁস উপহার দিয়ে পরবর্তীতে গরীব শ্রমিকদের বিক্রি অর্থ্যাৎ বাঁশ দেয়ার পরিকল্পনা করি না। আমরা আজ হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারছি, যেসব ভাইবোনেরা আমাদের দেশে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে এসেছিলেন তারা আমাদের মত মানুষ। আমরা তাদের দাস হিসেবে বিবেচনা করেছি। পৃথিবীর জৌলুসের ঝলকানি আমাদের অন্ধ করে রেখেছিল। যারা শ্রমিক হিসেবে এসেছিলেন তারা তাদের গরিবী দূর করতে এত দূর এসেছিলেন। সোনার বুট ,সোনার বল রাখার যায়গা তাদের ঘরে নেই। পরিবার ,সন্তানের মুখে একটু খাবার তুলে দিতে তারা এসেছিলেন আমাদের আমিরির কাছে। আমরা তাদের কে খেলার উপকরণ ভেবেছি। ইচ্ছেমত তাদের ব্যবহার করেছি আমরা। তাই হে বিশ্ববাসী আপনারা আজ আমার দিকে তাকান, দেখুন, আমার চোখ সাক্ষী দিচ্ছে আমি অনুতপ্ত। আমি নতশিরে ক্ষমা চাচ্ছি কৃতকর্মের জন্যে। প্রায় সাত হাজার ঘন্টার বিনোদনের জন্যে আমি সাতলক্ষ মানুষের জীবনকে ধ্বংস করতে পারি না। এই বিলাসের পথে কাতার আর যাবে না।
প্রিয় বিশ্ববাসী, লণ্ডনভিত্তিক সংগঠন ‘ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ এর দেয়া তথ্যমতে আমাদের স্টেডিয়াম, হোটেল বন্দর নির্মাণে প্রায় পনের হাজার শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। আমরা তাদের তথ্যে গুরুত্ব দেব, তবে আমি নিজে তদারকি করে সঠিক সংখ্যা বের করব। এটা আমার অঙ্গীকার। খেলা শেষ করে বিজয়ী দল কাপ নিয়ে ফিরছে ঘরে। বিজিত দলও পেয়েছে উষ্ণ অভ্যর্থনা। আগেকারদিনের মত পরাজিত দলের জন্যে জোটেনি বেত্রাঘাত। কিন্তু একটু সুখী জীবনের আশায় কাতার এসে যেসব শ্রমিক জীবনটা হারিয়েছেন, তাদের আমরা কী দিয়েছি ? ক্ষুধার পেটে খিল দেয়ার মত আজব কোন খেলা আমরা আবিষ্কার করতে পারিনি, খাবার ছাড়া। ফুটবল দুঃখ ঘোচাতে পেরেছে কয়জনের ? তবু ও এ মহা আয়োজন! দু:স্থ পা আর নির্জিব জড়বস্তুর পিটাপিটিতে ক্ষমতা দখল, হায়রে ফুটবল! বিশ্বকাপ ফুটবল!
ডিশ সংযোগ চলে যাওয়ায় আমিরের বক্তৃতার বাকি অংশটুকু আর শোনা হল না হারান বাবুর। হারান তার আসল নাম নয়। সারাটা জীবন খেলায় হেরেছেন তাই হারতে হারতে হারান। এটা সকলেই জানেন। জীবনে অনেকগুলো বিশ্বকাপ দেখেছেন। শেষ দিনে এমন আমিরি বক্তব্য শোনেননি। তাই বিশ্বাস করতে পরছেন না, আমির এসব বলতে পারেন। কেমন গল্প গল্প মনে হচ্ছে। তাই প্রভাত কুমারের গল্পের বাজিকরের মুখের কথা কেড়ে নিলেন, ‘আর কষ্ট দিও না ভগবান।’
সারা জীবন জিততে জিততে যিনি জিতেন বাবু হয়েছেন, তার বাড়ির সামনে বড়পর্দায় খেলা দেখার আয়োজন হয়েছে। ভিড়ের ভেতর কেউ একজন জানিয়ে দিয়ে গেল। হারান বাবু আর নেই। খেল খতম।
রম্যলেখক ও প্রাবন্ধিক