
শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। এক অনন্য মাতৃরূপ। সে রূপ প্রকাশ্যে কেউ দেখেনি। দেখার সুযোগ দেননি। তিনি ছিলেন নিভৃতচারী মাতা। অন্তরালে থেকে কাজ করে শেষ পর্যন্ত নিজের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন বাংলাদেশের জন্যে।
কন্যা হয়ে সেবা করেছেন শ্বশুর, শ্বাশুড়ির। যোগ্য অর্ধাঙ্গিনীরূপে আমৃত্যু পাশে ছিলেন জাতির পিতার। মা হিসেবে আগলে রেখেছিলেন নিজ পুত্র-কন্যা ও সাড়ে সাতকোটি বাঙালিকে। এই না হলে মা! ভালোবাসার হিসেব করেননি, বিলিয়েছেন অকাতরে।
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব এর জন্ম ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের গুলিতে হয় জীবনাবসান। দেহের আয়ু ফুরোলেই সব শেষ হয়ে যেতে পারে না।
শঙ্খ ঘোষ তার আয়ু কবিতায় লিখেছেন,
লেখো আয়ু লেখো আয়ু
চুপ করো, শব্দহীন হও।
বইয়ের হাটে, পার্থ প্রতিম সেনগুপ্ত, আয়ু নিয়ে দারুণ মন্তব্য করেছেন। তার কাছে ,‘লেখো আয়ু লেখো আয়ু” যেন এক মন্ত্রের মত। ছন্দগভীর ও সংকেতময়।
জীবনান্দ লিখেছিলেন
‘উজ্জ্বল আলোর দিন নিভে যায়,
মানুষেরো আয়ু শেষ হয়।
পৃথিবীর পুরানো সে পথ
মুছে ফেলে রেখা তার
কিন্তু এই স্বপ্নের জগৎ
চিরদিন রয়!”
স্বপ্ন চিরদিনের, আয়ু স্বল্প। আয়ু শেষ হয়ে যায়। প্রাণ নিভে যায়। তাহলে এ কোন বীজমন্ত্র মানুষের কানে দিতে চাইছেন কবি ?
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর শুরুটা এরকম-‘বন্ধুবান্ধবরা বলে, তোমার জীবনী লেখ। সহকর্মীরা বলে, রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাগুলি লিখে রাখ, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, বসেইতো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী।’
প্রিয় পাঠক, লক্ষ করুন। শঙ্খ ঘোষের মতো বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবও তাঁর স্বামীকে আয়ু লেখার কথা বলছেন। সে কি অজ্ঞানে ? মোটেই না। আঠারো বাক্যের ভূমিকায় জাতির পিতা আবার লিখেছেন, ‘আমার স্ত্রী যার ডাকনাম রেণু-আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।’
বঙ্গমাতার প্রেরণায় অসমাপ্ত আত্মজীবনী লেখা শুরু করলেন মুজিব। বাংলাদেশের আয়ু লিখা হয়ে গেল পিতার কলমে। এ আয়ু ফুরোবার নয়। জীবনীতে জীবন মেশে। কত কথা, সুখ-দুঃখ, মিলন-বিরহ জড় হতে থাকে কাগজের পাতায়। আয়ুর পর আয়ু জড় হতে থাকে। এ রচনা ধ্বংসে এমন সাধ্য কার ! শত সহস্র দুর্বিপাকে এ লেখাগুলোকে আগলে রাখেন বঙ্গমাতা। তুলে দিন ভরসার প্রতীক কন্যা শেখ হাসিনার হাতে। আমরা হাতে পাই পিতার অমর লেখা। অসমাপ্ত আত্মজীবনী। আয়ুর লয় নেই। পিতার আয়ু সমাপ্ত হতে পারে না। নিজ হাতে আয়ু লিখে গেছেন পিতা। লেখো আয়ু লেখো আয়ু।
কারাগারের রোজনামচা’র ৪৭নম্বর পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু, লদু ওরফে লুৎফর রহমান এর জীবনের কথা বৃহৎ পরিসরে লিখেছেন। ১৯৫০ সালে জেলে লদুর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। লদু পেশায় একজন চোর। তাঁকে নিয়ে পিতা জীবনের এক বড় গল্প লিখেছেন। শেখ মজিবুর রহমানের মত বিশ্বমানের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের রোজনামচায় ঠাঁই করে নিয়েছে লদু চোরা। কেমনে? সেই আয়ু লেখা। লেখো আয়ু লেখো আয়ু। কি অনির্বাণ মন্ত্র! জেলগেটে বঙ্গবন্ধুকে দিয়েছিলেন বঙ্গমাতা।
পড়ুন কারাগারের রোজনামচা পৃষ্ঠা ৪৮। বঙ্গবন্ধু লিখছেন, ‘লদু বলতে লাগল, আর আমি ঘটনাগুলি লিখতে শুরু করলাম। একটা সামান্য চোরের জীবন আমি কেন লিখছি-এ প্রশ্ন অনেকেই আমাকেই করতে পারেন। আমি লিখছি এর জীবনের ঘটনা থেকে পাওয়া যাবে আমাদের সমাজ ব্যবস্থার চিত্র। মনুষ্য চরিত্র সম্বন্ধে, যারা গভীরভাবে দেখতে চেষ্টা করবেন, তারা বুঝতে পারবেন আমাদের সমাজের দুরবস্থা এবং অব্যবস্থায় পড়েই মানুষ চোর ডাকাত পকেটমার হয়। আল্লাহ কোন মানুষকে চোর ডাকাত করে সৃষ্টি করে না। জন্ম গ্রহণের সময় সকল মানুষের দেল একভাবেই গড়া থাকে। বড় লোকের ছেলে ও গরিবের ছেলের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না, যেদিন জন্মগ্রহণ করে। আস্তে আস্তে এক একটা ব্যবস্থায় এক একজনের জীবন গড়ে ওঠে। বড়লোক বা অর্থশালীর ছেলেরা ভাল খায়, ভাল পরে, ভাল শিক্ষা পায়। আর গরিবের ছেলেরা জন্মের পরে যে অবস্থা বা পরিবেশে বেড়ে উঠে এবং যাদের সঙ্গে মেলামেশা করে তাদের স্বভাব চরিত্রই তারা পায়।’
লদুর জীবনের গল্পে লেখক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তা প্রমাণ করেছেন নিপুণ দক্ষতায়। সমাজ বদলাবার নিমিত্তে, অসুস্থ সমাজের ছবি এঁকেছেন । এ লেখার অনুপ্রেরণা যে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব তা বারবার উঠে এসেছে পিতার লেখায়।
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব এর শিক্ষা সম্পর্কে তাঁর বড় মেয়ে শেখ হাসিনা লিখেছেন,
“আমার মা মিশনারি স্কুলে কিছু প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। কিন্তু তারপর আর বেশিদিন স্কুলে যেতে পারেননি, স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল বলে। আর ওই এলাকায় স্কুলও ছিল না। একটাই স্কুল ছিল, জিটি স্কুল। অর্থাৎ গিমাডাঙ্গা টুঙ্গিপাড়া স্কুল। যেটা আমাদের পূর্ব পুরুষদেরই করা। আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় এক মাইলের ওপর, প্রায় দেড় কিলোমিটারের কাছাকাছি। দূরে কাঁচা মাটির রাস্তা। একমাত্র কাঁচামাটির রাস্তা দিয়ে যাও অথবা নৌকায় যাও, মেয়েদের যাওয়া একদম নিষিদ্ধ। বাড়িতে পড়াশোনার জন্য প-িত রাখা হতো। মাস্টার ছিল আরবি পড়ার জন্য। কিন্তু আমার মা’র পড়াশোনার প্রতি অদম্য একটা আগ্রহ ছিল।’
১৯৪৬ সালের দাঙ্গা, ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যূত্থান নেপথ্যে থেকে লড়েছেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।
৭ই মার্চের ভাষণের স্মৃতি নিয়ে মুজিবতনয়া শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘৭ মার্চের ভাষণের কথা বরাবরই আমি বলি। বড় বড় বুদ্ধিজীবি লিখে দিয়েছেন, এটা বলতে হবে ওটা বলতে হবে। কেউ কেউ বলছেন, এটাই বলতে হবে। না বললে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এ রকম বস্তাকে বস্তা কাগজ আর পরামর্শ। গুরুত্বপূর্ণ কিছুতে যেতে হলে আমার মা কিন্তু আব্বাকে বলতেন, ‘কিছুক্ষণ তুমি নিজের ঘরে থাক।’ তাঁকে ঘরে নিয়ে তিনি একটা কথা বললেন যে, ‘তোমার মনে যে কথা আসবে, তুমি সেই কথাই বলবা। কারণ লাখো মানুষ সারা বাংলাদেশ থেকে ছুটে এসেছে- হাতে বাঁশের লাঠি, নৌকার বৈঠা নিয়ে। আর এদিকে পাকিস্তানি শাসকরাও অস্ত্রটস্ত্র নিয়ে বসে আছে এই বলে যে, বঙ্গবন্ধু কী নির্দেশ দেন।’
কোনো লিখিত ভাষণ ছিল না। স্বাধীনতার দীক্ষামন্ত্রের কোন খসড়া ছিল না। যে ভাষণে বঙ্গবন্ধু লিখলেন বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের আয়ু, তার অন্তরালে ছিল একজোড়া চোখ, মহিয়সী নারী শেখ ফজিলাতুন্নেছা। প্রণমি মাতা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়ে বলি, ‘শেখ ফজিলাতুন্নেছা আমার মা।’ বঙ্গমায়ের চিরন্তন রূপ চিরবিরাজমান থাকুক বাঙালি নারীত্বে। কোটি কোটি আয়ু লিখে যাক বাঙালি। পরপারে শান্তিতে থাকুন মা ফজিলাতুন্নেছা।
আরও পড়ুন: খুঁটির জোর ও খেতু কাহিনি
কলামলেখক ও প্রাবন্ধিক