![খুঁটির জোর ও খেতু কাহিনি খুঁটির জোর ও খেতু কাহিনি](https://www.durjoybangla.com/media/imgAll/2023April/জোর-ও-খেতু-কাহিনি-2304210536.jpg)
খুঁটির জোর ও খেতু কাহিনি
১৮৯২ সাল হতে ২০২৩ সাল, প্রায় দেড়শ বছর। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সমাজ শরীরের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। অনেক সমাজ সংকটে পড়ে বিলুপ্ত হয়েছে। মানে সম্মানে জনসংখ্যায় অনেক মানব সমাজের শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। উল্লিখিত সময়ে বাঙালি সমাজের শরীরের অনেক সৌন্দর্য্ বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু মনের কোন পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। ১৮৯২ সাল ভিত্তি ধরার কারণ ত্রৈলক্যনাথ মুখোপাধ্যায় এর উপকথার উপন্যাস কঙ্কাবতী। গল্প উপন্যাসে সাহিত্যিকেরা সময়কে ধরে রাখেন। ১৮৯২ সালে কঙ্কাবতী উপন্যাস প্রকাশিত হয়। এ উপন্যাসে ব্যাঙ্গরূপে ত্রৈলক্যনাথ যে ছবি একেঁছিলেন, ২০২৩ সালে এসে বাঙালি মননের একটুকুও চিঁড় ধরেছে বলে মনে হয় না। শ্বশুর এবং জামাইয়ের একটু আলাপন বর্তমান বাঙালি সমাজের কপালে লেপে দিতে চাই। পৃথিবীর সকল সভ্য সমাজ মূলত একই বলয়ে ঘুরছে।
বাঘরূপী খেতু স্ত্রী কঙ্কাবতীকে নিয়ে শ্বশুরালয়ে এসেছেন। কঙ্কাবতীর পিতা তনু রায়, মাতা, ভাই বোন সকলেই খুশি শ্বশুর বাড়ির সকলেই প্রচুর টাকা মোহর পেয়েছেন। তাই বাঘরূপী জামাই খেতুর আদরের আর স্থান হয় না।
ধনলোভী শ্বশুর তনু রায় বাঘ জামাতার আপ্যায়নের বিষয়ে বিষম চিন্তায় পড়লেন। তনু রায় বললেন “ বাবাজি ! এত পথ আসিয়াছ, ক্ষুধা অবশ্যই পাইয়াছে।কিন্তু আমাদের ঘরে কেবল ভাত ব্যঞ্জন আছে, আর কিছুই নাই। ভাত-ব্যঞ্জন তোমার খাদ্য নয়। তাই ভাবিতেছি তোমাকে খাইতে দিই কি ? তা তুমি এক কর্ম কর। আমার গোয়ালে বৃদ্ধা এক গাভী আছে। সময়ে সে দুগ্ধবতী গাভী ছিল। এখন তাহার বৎস্য হয় না, এখন আর সে দুধ দেয় না। বৃথা কেবল বসিয়া খাইতেছে। তুমি সেই গাভীটিকে আহার কর।তাহা হইলে তোমার উদর পূর্ণ হইবে। আর মিছামিছি আমাকে খড় যোগাইতে হবে না।”
বাঘরূপী খেতু গাভী ভক্ষণের আহ্বান সাদরে ফিরিয়ে দিলেন।
আপনাদের জানিয়ে রাখা উচিৎ তনু রায় হিন্দু ধর্মের একজন শাস্ত্র বিচারক। গাভীকে দেবী হিসেবে হিন্দুরা মানেন, এটি তিনি জানেন। মুশকিল হল তনু রায়ের শাস্ত্রজ্ঞান বিক্রির জন্য, জনহিত বিচারের জন্য নয়। তাই অর্থের প্রাপ্তি ঘটলে তিনি শাস্ত্রের ব্যাখ্যা অর্থের অনুকূলে দিয়ে থাকেন। তার কাছে নিজের স্বার্থ ব্যতিত সন্তান, স্ত্রী, পিতা মাতা সবই মূল্যহীন। একদিন যে গাভী দুধ দিয়ে, বাছুর দিয়ে তনু রায়ের তনু রক্ষায় ভূমিকা রেখেছে, আজ অথর্ব বুড়ো গাভীকে বাঘের মুখে ঠেলে দিতে তার বিবেকে বাধার কথা নয়।যুগে যুগে তনু রায়রা এমন হয়। ত্রৈলক্যনাথের আমলের তনু রায় গ্রামে শাস্ত্র বিচার করতেন পার্থক্য শধু বর্তমান কালের তনু রায় ডিজিটাল, স্মার্ট। লোভী তনু রায়ের যে ছবি ত্রৈলক্যনাথ তুলে ধরেছেন তা হচ্ছে অকৃতজ্ঞতা। পৃথিবীর সকল সমাজে অকৃতজ্ঞ তনু রায়দের জয়জয়কার।
তনু রায় গাভী আপ্যায়নে ব্যর্থ হয়ে জামাইকে অন্য প্রস্তাব দিলেন-“ আচ্ছা যদি তুমি গাভীটি না খাও, তাহা হইলে না হয়,আর একটি কাজ কর। তুমি নিরঞ্জন কবিরত্নকে খাও। তাহার সহিত আমার চির বিবাদ। সে শাস্ত্র জানে না। তবু আমার সহিত তর্ক করে। তাহাকে আমি দুটি চক্ষু পাড়িয়া দেখিতে পারি না।সে এ গ্রাম হইতে এখন উঠিয়া গিয়াছে। এখান হইতে ছয় ক্রোশ দূরে মামার বাড়িতে গিয়া আছে। আমি তোমায় সব সন্ধান বলিয়া দিতেছি। তুমি স্বচ্ছন্দে গিয়া তাহাকে খাইয়া আইস।”
ছদ্মবেশী বাঘ, খেতু তাও অস্বীকার করলেন। বললেন তার ক্ষুধা নেই।
নিরঞ্জন কবিরত্ন একজন বিদ্বান ব্যক্তি। সৎ এবং পরোপকারী,নির্লোভ ব্যক্তি। তনু রায়ের মত অসৎ লোকের কারণে নিজ গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। দেশান্তরী হয়েও তনু রায়ের মত মানুষের হিংসার আগুন থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। ঈর্ষা ও হিংসার বশীভূত হয়ে মিথ্যুক, ভুল শাস্ত্র ব্যাখ্যাকারী তনু রায় নিরঞ্জন কবিরত্নকে বাঘের খাবারে পরিণত করতে চায়।বাঘ তার জামাতা হওয়ায় সে এ সুযোগ কাজে লাগাতে চায়। বিশ্বসমাজে নিরঞ্জন কবিরত্নরা আজও নিরাপদ নয়। তনু রায়ের মত মানুষরা সমাজের ভালো লোকদের বাঘের খাবার হিসেবে তুলে দেয়। ছলে বলে কৌশলে সমাজ থেকে ,দেশ থেকে, দুনিয়া থেকে এমনকি ইতিহাসের পাতা থেকে এদের নাম মুছে দিতে চায়। হাল সময়ে সমাজে চলছে ছদ্মরূপী বাঘ সিংহদের রাজত্ব। হিংস্র জানোয়ারদের বন থেকে ধরে এনে চিড়িয়াখানায় বন্দী করা হয়েছে। আর হিংস্র জানোয়ারদের কাজ প্রকাশ্য দিবালোকে করছে মানুষ। জামাই হিসেবে এসব বাঘ সিংহ এমনকি শেয়ালের কদরও খুব বেশি। বর হিসেবে কেউ সাদাসিদে মানুষ পছন্দ করে না। ভালো মানুষ হিসেবে তার প্রশংসা ঠিকই করে কিন্তু তার কাছে মেয়েরা নিরাপদ বোধ করে না।সমাজের ভালো মানুষেরা দুর্বল মানুষ হিসেবে পরিচিত। কারো সাতে পাঁচে নেই। খেতু মোটামুটি এরকম মানুষ ই। শুধু কঙ্কাবতীর মঙ্গল করতে গিয়েই তার এই দুরাবস্থা।
শ্বশুর তনু রায় ভাবলেন, জামাতা বাঘ রাত্রিবেলা এতদূরে যেতে চাচ্ছে না। তাই নিরঞ্জন কবিরত্নকে খেতে চাচ্ছে না। তিনি নতুন প্রস্তাব করলেন-“ আচ্ছা ! ততদূর যদি না যাইতে পার, তবে এ গ্রামেই তোমার আমি খাবার ঠিক করিয়া দিতেছি। এই গ্রামে এক গোয়িালিনী আছে।মাগী বড় দুষ্ট। দু’বেলা আসিয়া আমার সাথে ঝগড়া করে। তোমাকে কন্যা দিয়াছি বলে মাগী আমাকে যা নয় তা বলে। মাগী আমাকে বলে-অল্পায়ু, বুড়ো, ডেকরা। টাকা নিয়ে কিনা বাঘকে মেয়ে বেচে খেলি। তুমি আমার জামাতা, ইহার একটা প্রতিকার তোমাকে করিতে হইবে।”
খেতু এই প্রস্তাবও সবিনয়ে প্রত্যাখান করলেন।
খেতু একজন মানবিক মানুষ। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত খেতু গল্পের খাতিরে বাঘ সেজেছেন। তাই শ্বশুরের অপমানে তার মনে প্রতিশোধস্পৃহা জাগেনি। অসহায়তার প্রতীক গোয়ালিনী তাই বাঘের হাত থেকে বেঁচে গেলেন।কঙ্কাবতী লক্ষীমতি মেয়ে। বাবার অসৎ চরিত্রের কথা তার জানা। তাই স্বামীকে অসৎপথে কখনো ঠেলেননি।চতুর শ্বশুর তনু রায় বাঘ জামাতাকে অসৎ কাজে ব্যবহার করতে পারেননি। তবে পর্যাপ্ত সম্পদ পাওয়ায় জামাইয়ের নিন্দা করেননি।
বর্তমান ইঙ্গ-ব্যঙ্গ সমাজে বাঘরূপী জামাতারা শ্বশুরের কুপ্রস্তাব ফেলতে পারেন না বরঞ্চ লুফে নেন। যে জামাই যত খতরনাক কাজ করতে পারেন তার রেপুটেশন তত ভারি। শ্বশুরপক্ষের প্রস্তাবে বউদের প্রভাব কোন অংশে কম নয়। শ্বশুর পক্ষের প্রস্তাবে রাজি না হলে সংসার ছারখার হয়ে যেতে পারে। ম্যাডামের ইজ্জত বলে কথা।তাই জামাতার ক্ষমতা মানেই শ্বশুরের ক্ষমতা। অপরপক্ষে শ্বশুরের ক্ষমতাও জামাইয়ের ক্ষমতার উৎস। একজন বাঘ হলে অন্যজন সিংহ।
তবুও একবিংশ শতাব্দীর এ সমাজে বাঘরূপী ক্ষমতাবান সকর জামাতা একরূপ নন। অনেকেই আছেন, তনু রায়ের মত অসৎ ম্বশুরের অবৈধ প্রস্তাবে রাজি হন না। তাদেরকে মিথ্যে অপবাদের মুখোমুখি হতে হয়্ । শ্বশুর পক্ষ হোক আর নিজপক্ষ হোক সকল পক্ষের তরফ থেকে নিন্দা জোটে তার কপালে। বিশাল ক্ষমতাধর হয়েও আত্মীয়-স্বজনের জন্য অবৈধ কিছু না করতে পারার অক্ষমতায়, স্বার্থপরের অপবাদ জোটে।“ শুধু নিজেরটাই দেখে গেল ছেলেটা”-এই অভিযোগ থেকেই তিনি হোন আত্মীয়স্বজনবিহীন এক রূঢ় ব্যক্তি।সবাই রটিয়ে বেড়াবে, ‘কার কাছে যাবে ও নিজেরটা ছাড়া কিছুই বুঝে না। আবদারের মিছিল নিয়ে দুই পারের লোকজন দুইদিকে দেয়াল তোলে রাখে ব্যর্থ জামাইকে।
এ বিরল প্রকৃতির জামাই খুব কম, যিনি শ্বশুরের কথা শোনেনা। একবার যিনি নিজের ক্ষমতা বিক্রি করেছেন, তাকে আর কিছুেই করতে হয় না। আত্মীয় স্বজনরা তার পরিচয় বিক্রি করে বৈধের চেয়ে অধিক হারে অবৈধ কাজ করে নেয়। ক্ষমতাবান আমলা, রাজনীতিবিদ, শিল্পি, খেলোয়াড়, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার জামাতা যার, সমাজে সেই শ্বশুরের ক্ষমতা অপার। পীরের নাম নিয়ে ফু দিলেই পুরো পুকুরের পানি যেভাবে পড়া পানি হয়ে যায়, তেমনি বাঘের মত ক্ষমতাধর জামাইয়ের নাম নিলেই সকল মুসকিল আছহান হয়ে যায়।
রম্যলেখক