মঙ্গলবার ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০ আশ্বিন ১৪৩০

হেলাল উদ্দিন বয়াতী নিভৃতচারী একজন জারি গায়ক

প্রকাশিত: ১৪:৫৪, ১৮ আগস্ট ২০২৩

আপডেট: ১৪:৫৮, ১৮ আগস্ট ২০২৩

হেলাল উদ্দিন বয়াতী নিভৃতচারী একজন জারি গায়ক

হেলাল উদ্দিন বয়াতী নিভৃতচারী একজন জারি গায়ক

মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন একজন নিভৃতচারী জারিগানের বয়াতী।সারল্যে ভরপুর নির্ঝঞ্ঝাট সাদামাটা জীবনযাপনকারী এই মানুষটির জন্ম ১৯৬৫ সনে নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলার কান্দিউড়া গ্রামে। পিতামৃত ফরেহোসেন মাতামৃত রমজান আকতার। তিনি দশম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। তার সহোদর বড় ভাই ফয়েজ উদ্দিন আহমেদ ছিলেন আশির দশকের অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন জারিগানের বয়াতী।

তার কাছেই হেলাল উদ্দিন বয়াতীর জারিশিক্ষার হাতেকড়ি। বড়ভাই ফয়েজ উদ্দিন বয়াতী ১৯৯১সনে প্রয়াত হওয়ার পর দ্বিতীয় ওস্তাদ ধরেন ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার হস্তি গ্রামের সুনামধন্য জারিগানের বয়াতী আব্দুল খালেক দেওয়ানকে।

তিনি জানান,১৯৮৮ইং সনে বয়াতী হিসেবে জারিগানের প্রথম আসর করেন কেন্দুয়া উপজেলার পালড়া গ্রামে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত বলা যায় প্রতিবছর বিভিন্ন অঞ্চলে সদলবলে জারিগান গেয়ে যাচ্ছেন। এ পর্যন্ত তিনি শতাধিক আসরে জারিগান গেয়েছেন বলে জানান। বিভিন্ন জারি প্রতিযোগীতায় অংশ নিয়ে পুরস্কৃতও হয়েছেন বলে জানান। তিনি ঢাকার শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ সচিবালয়, ময়মনসিংহ, গফরগাঁও, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, ত্রিশাল সৈয়দ নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়,ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরসহ বিভিন্ন স্থানে জারিগান পরিবেশন করেছেন। এ ছাড়াও রাখাল বিশ্বাসের আয়োজনে বিটিভির একটি অনুষ্ঠানে জারিগান পরিবেশন করে সুনাম অর্জন করেন। 

তিনি আরও জানান, কেন্দুয়া বাজার কমিটির সভাপতি এনামুল হক ভূঞার নেতৃত্বে কান্দিউড়া গ্রামের ঐতিহ্যবাহী জারিদল নিয়ে বহু জায়গায় জারিগান পরিবেশন করে পুরস্কৃত ও দল সম্মানিত হয়েছে।

তিনি যাদের সঙ্গে জারিগান করেছেন তাদের অনেকেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। উল্লেখযোগ্যদের মাঝে-কেন্দুয়ার চিথুলীয়ার লাডু বয়াতী, ছিলিমপুরের ওয়াহেদ আলী বয়াতী,রাজিবপুরের হেলিম বয়াতী, কান্দিউড়ার আবুল হাসেম বয়াতী, দূর্গাপুরের রহিছ উদ্দিন বয়াতী, ছিলিমপুরের ইদ্রিছ বয়াতী, মজলিশপুরের আবদুস সালাম বয়াতী, কলসহাটির মজনু বয়াতী, ঈশ্বরগঞ্জের দুদু মিয়া বয়াতী, গফরগাঁওয়ের খালেক দেওয়ান বয়াতী,বারহাট্টার লাল মিয়া বয়াতী, মদনের বাচ্চু মিয়া বয়াতী,বারহাট্টার আসর্জ্জমান বয়াতি, কলমাকান্দার মফিজ বয়াতীসহ অনেকের সঙ্গেই প্রতিযোগীতা ও প্রীতি কিংবা মানতের জারিগান গেয়েছেন।

হেলাল উদ্দিন বয়াতির স্ত্রীর নাম সামছুন্নাহার। দুই মেয়ে বেবি আক্তার ও কাজল আক্তারকে বহু আগেই বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলের বড় ছেলেকে বিয়ে করিয়েছেন, ছেলের বৌ স্বপ্না আক্তার এবং দুই নাতনী রয়েছে। বড় ছেলে রুবেল মিয়া সামান্য আয়ের কাজ করেন, ছোট ছেলে সোহাগ মিয়া কলেজ ছাত্র। হেলাল উদ্দিন বয়াতি এক সময় বেশ কিছু নাট্যপালায় যশের সাথে অভিনয়ও করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে দর্জির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি। তাঁর অর্থ কষ্ট থাকলেও নিজের দৈনতা প্রকাশ করেননি কখনো।

বয়াতি জানান,৬/৭বছর আগে স্ট্রোক করে অসুস্থ্য হন। তখন থেকে কথা বললে কাঁপাকাঁপা ভাবে মাথা নড়ে। স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যহত হয়। আর্থিক অনটনের জন্য ভাল চিকিৎসা করাতে পারেননি। তার পরও জারিগানকে ভালবেসে এখনো আঁকড়ে ধরে আছেন বিষাদ সিন্ধু।

তিনি বলেন-এখন মহরম মাসেই কিছু জারিগান হয়।অথচ এক সময় নেত্রকোণার প্রতিটি গ্রামেই জারিদল গঠন করে সারা বছর জারিগান হতো। এছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে সরকারি বেসরকারি আয়োজকগণ জারিগান গাওয়াতেন - আজ তা অনেকাংশেই কমে গেছে। জারিগান ইসলামধর্ম চেতনার একটি অংশ। ইমাম হাসান হোসেনের বিয়োগান্তক কাহিনী নিয়ে মীর মোশাররফ হোসেনর কালজয়ী গ্রন্থ 'বিষাদ সিন্ধু' থেকে আমরা জারিগান গেয়ে থাকি। জারিগান মূলত 'মাতম' কারবালা প্রান্তরের মর্মন্তুক কাহিনী নিয়ে রচিত পুরোটাই বিষাদময় আখ্যান।

আমরা তা দলীয় ভাবে বিশেষ মর্যাদায় কিন্নরীয় মাধুর্যমন্ডিত করে ধর্মীয় ভাবগাম্ভির্যের মাধ্যমে জারিগান গেয়ে থাকি।এসময় আনেকেই নবী বংশের শেষ পুত্তুলীগণের করুণ কাহিনীতে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে চোখের জল ফেলেন, পর্দার আড়ালেও মা বোনেরা জারিগান শুনে কাঁদেন। আমার কান্দিউড়া গ্রামে হাসেম বয়াতি নামে আরও একজন জনপ্রিয় বয়াতি আছেন তিনিও জাতীয় পর্যায়ে বহুঅনুষ্ঠান করেছেন এবং আমার গ্রামে বড়দের একটি এবং বালকদের একটি মোট দুইটি জারিদল রয়েছে। গ্রামে জারি সমিতি নামে একটি সমিতি রয়েছে।সেটি পরিচালনা করেন দলের সভাপতি কেন্দুয়া পৌর আওয়ামীলীগের সভাপতি ও কেন্দুয়া বাজার কমিটির সভাপতি এনামুল হক ভূঞা।

তিনি বলেন,আমি চাই আগের মত জারিগান পরিবেশন অব্যাহত থাকুক  এবং গ্রামে গ্রামে জারিদল গঠন করে নতুন বয়াতি ও ডাইনাসহ খেওড়াল তৈরি হোক এটাই আমার চাওয়া।

আরও পড়ুন: কেন্দুয়া হরিসভা দূর্গা মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা