
দীপাবলির আলোয় জীবনের গান
জর্জ বার্নার্ড শ'র পর্যবেক্ষণ," মানুষ চায় অন্যের আলো কেড়ে নিতে, নইলে তার নিজের ঔজ্জ্বল্য ভালোমতো প্রকাশ পায় না। মানুষ চায় প্রতিযোগী প্রতিদ্বন্দ্বী ও পার্শ্ববর্তীজনের চেয়ে আকর্ষণীয় থাকতে; বন্ধু-ভ্রাতা ও আত্মীয় স্বজন থেকে উজ্জ্বল থাকতে এবং কখনো কখনো নিজের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে পর্যন্ত অনুজ্জ্বল রাখতে। মানুষ চূড়ান্ত বিশ্লেষণে নিজেকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।"
দীপাবলির উৎসব বার্নার্ড শ'র পর্যবেক্ষণ কে কলা দেখিয়ে বলে, মানুষ শুধু নিজের ঘরের অন্ধকার দূর করতে চায় না। দীপাবলির দিনে রাস্তায় নেমে আসে মানুষ। যেখানেই অন্ধকার সেখানেই আলো জ্বালিয়ে দূর করে অমাবস্যার অন্ধকার। প্রার্থনা করে পৃথিবীর সবার অন্ধকার এই দীপালোকে দূর হয়ে যাক।
দীপাবলি, দেওয়ালি, দীপান্বিতা যে নামেই ডাকুন না কেন এ সবই আলোর উৎসব। বিজয়ার উৎসব। অন্ধকার থেকে আলোতে আসার আনন্দ উৎসব। হিন্দু বৌদ্ধ যৈন শিখ যে ধর্মের কারণে এ উৎসব পালন করা সবই বিজয়ার উৎসব।
অন্ধকার গুহাচারী মানুষ আলো জ্বালার মাধ্যমেই সভ্যতার সূচনা করেছিল। আগুনকে ভালোবেসে কাজে লাগিয়েছিল। আগুন মানুষকে মানুষ করেছিল। তাই মানুষের কাছে আগুনের আলো মঙ্গলের আলো। মঙ্গল আলো জ্বেলে অন্ধকার দূর করার উৎসব পৃথিবীর অনেক দেশে পালন করা হয়। কবে তার সঠিক শুরু কেউ জানে না।
বেশিরভাগ হিন্দু মনে করে লঙ্কা জয় করে রাম যখন অযোধ্যায় ফেরেন সেদিন থেকেই শুরু দীপাবলি। অযোধ্যা নগরী সেই দিন সেজেছিল অপূর্ব সাজে। ঘরে ঘরে সহস্র সীতা মাতা জ্বালিয়েছিলেন প্রদীপ। হরেক রকমের প্রদীপ। অযোধ্যাবাসী এখনো তাদের এই উৎসবকে অন্যতম প্রধান উৎসবের মর্যাদায় রেখেছে।
দীপাবলি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উৎসব । 'দীপ' এবং 'অবলি'— এই দুইয়ে মিলে হয়েছে সংস্কৃত দীপাবলি শব্দটি। 'দীপ' শব্দের অর্থ 'আলো' এবং অবলি শব্দের অর্থ 'সারি'। ভারতে এক দিন নয়, পাঁচ দিন ধরে পালিত হয় এই উৎসব। কেবল ভারতেই নয়, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, মিয়ানমার, মরিশাস, নেপাল, গায়ানা, সিঙ্গাপুর, সুরিনাম, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা এবং ফিজিতেও দেওয়ালি পালন করা হয়।
শত্রুর অমঙ্গল কামনায় লোকে বলে তার বংশে যেন বাতি দেওয়ার লোক না থাকে। বংশধরেরা বাতি দেয় এই দীপাবলিতে। চৌদ্দ পুরুষ খুশি হয়ে তখন আশীর্বাদ করেন । তাই সকল মানুষই উত্তরাধিকারী রেখে যেতে চায়। বংশে বাতি দেওয়ার লোক যেন থাকে। স্বর্গের লোভও মানুষকে পৃথিবীর টান থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। মানুষ পৃথিবীর বুকে তার পদচিহ্ন রেখে যেতে চায়। পেটের ক্ষুধা মিটে গেলে এই কাজেই কাটে বুদ্ধিমান মানুষের জীবন।পৃথিবীর মাটি বায়ু পানি বিশেষ করে জন্মভিটার টান মানুষ ভুলতে কি পারে?
নশ্বর শরীর, পৃথিবী থেকে এক সময় বিদায় নিলেও প্রাণ,মন ! যেমন দেশ ছেড়ে বিদেশ গেলে মাতৃভূমির জন্য মন উচাটন করে।
স্বামীর বিপন্ন অবস্থায় বাপের বাড়ির পাশে একখণ্ড জমিতে ঝুপড়ি ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন সুনি পিসি । আজ ভূত চতুর্দশী। দীপাবলি। চৌদ্দ পুরুষ সেই যে পিতৃপক্ষে মর্ত্যে এসেছিলেন আজ বিদায় নিচ্ছেন । চৌদ্দ পুরুষের ভিটেতে দীপ জ্বালানোর আজ কেউ নেই।
চণ্ডীপুরের বড় আমগাছটার তলায় কলাগাছের খোলে তেল দিয়ে সলতে জ্বালিয়েছেন । অভাবের সংসারে সলতে জ্বালাবার মত তেল কেনার টাকা নেই তার। তাই মায়ের কাছ থেকে চেয়ে এনেছেন তেল। আজ সুনি পিসির দীপাবলি। ভূত হয়ে ক্ষতি করো না পূর্ব পুরুষেরা। আলোর উৎসবে বিনীত প্রার্থনা সুনি পিসির।
মায়ের কাছে বসে গল্প করতে ইচ্ছে করছে। কিন্ত মা নামাজ থেকে উঠতেই যেন চাইছে না। সুনি পিসির চোখের সামনে ভেসে ওঠেছে একাত্তরের যুদ্ধের আগের বছরের ছবি। বাবা তখন জীবিত। শরীর খারাপ। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। তবুও তিনি কাজে লেগেছেন। আজ দীপাবলি। কলাগাছের ভেলা বানাচ্ছেন। টেটুয়া বাঁশ দিয়ে কেরোসিন তেলের মশাল বানাচ্ছেন। ভেলায় দিতে হবে আগুন মশাল। যোগীর পুকুরে ভাসবে চৌদ্দ পুরুষের ডিঙ্গা। বাবা আজ নেই। দুটি পুত্র থেকেও আজ তার বংশের পুরুষ নেই। দেশ ভাগ, যুদ্ধ, সাম্প্রদায়িকতা সব কেড়ে নিল। আজ নিসম্বল সুনি পিসি ই বংশের বাতি।
দীপাবলির আলো জ্বেলে আমরা আসলে নরকাসুরের জয়ের ঘটনা স্মরণ করি। এমনি এক অমাবস্যার রাতেই নাকি শ্রীকৃষ্ণের হাতে নিহত হয়েছিলেন ত্রিলোকের ত্রাস নরকাসুর। ষোল হাজার বন্দিনী নারী মুক্তি পেয়ে আবার সংসারে ফিরে এসেছিলেন, ঋষিরা আবার দিনের আলো দেখতে পেয়েছিলেন। কলঙ্কমুক্ত পৃথিবী তাই সেদিন আলোয় আলোয় অপরূপা সেজেছিল মর্ত্যবাসী আনন্দে হেসেছিল। সেই দিন স্মরণ করে এখনো দ্বীপ জ্বালায় মানুষ।
মহাভারতে পাওয়া যায় যে বারো বছর বনবাস ও এক বছর অজ্ঞাতবাসের পর দীপাবলিতেই হস্তিনাপুরে ফিরে এসেছিলেন পাণ্ডবরা। সেই জন্য আলোর মালায় সাজানো হয়েছিল গোটা হস্তিনাপুরকে। দিনটি এখনো পালিত হচ্ছে। কুরুদের চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়ে পাণ্ডবদের ঘরে ফেরায় আনন্দের বন্যা হয়েছিল হস্তিনাপুরে। সে আনন্দ আলো এখনো জ্বলে দীপাবলিতে।
দীপাবলি- শুধু সনাতনধর্মীদের নয়, শিখ এবং জৈন ধর্মাবলম্বীদেরও অনুষ্ঠান। জৈন ধর্মের প্রবর্তক মহাবীর ৫২৭ অব্দে দীপাবলির দিনে মোক্ষ (নির্বাণ) লাভ করেন। তাই দীপাবলির দিন জৈনদের কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
দীপাবলির দিনে শিখ ধর্মগুরু গুরু হরগোবিন্দ অমৃতসরে ফিরে আসেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরকে পরাজিত করে গোয়ালিওর দুর্গ থেকে বায়ান্ন হিন্দু রাজাকে মুক্ত করেন। তাঁর এই প্রত্যাবর্তনকে শিখগণ পালন করেন।
তারা এই দিনকে 'বন্দী ছোড় দিবস'ও বলেন।
এই অন্ধকার রাতেই শ্যামা পূজা। অন্ধকার ভেদ করে আলোর দেবী পূজিত হোন গভীর রাতে। আদ্যাশক্তির পূজার ধরণ বিচিত্র। কল্পনাকেও হার মানায় তাঁর ভক্তরা। আর্য অনার্য, চোর পুলিশ কে না তার ভক্ত। কালী মন্দির নেই এমন বন্দর নগর পাওয়া যাবে ভারতবর্ষে? অমানিশার ঘোর অন্ধকার দূর করে আলোক জ্বেলে কালীপূজা করে ভক্তরা। রামপ্রসাদ, নজরুল যুগে যুগে ফিরে আসবেন শ্যামা সঙ্গীত নিয়ে।
বলিরে ছলিতে হরি হইলা বামন। হিন্দু ধর্মের দশাবতারের বামন অবতারও দীপাবলির আন্যতম কারণ। প্রজারঞ্জক রাজা ছিলেন মহাবলী। শক্তিমানও বটে। তাঁর ভয়ে দেবতারাও শঙ্কিত। কিন্তু প্রজারা তাকে ভালোবাসে। ভীত দেবতাদের প্রার্থনায় বিষ্ণু বামন বেশে মহাবলীর সামনে এসে হাজির হলেন। মহাবলী জানতে চাইলেন তিনি কী চান। বামনরূপী বিষ্ণু বললেন- ত্রিপাদ ভূমি। দানশীল মহাবলী তাতে আপত্তি করলেন না। তিনি বামনের প্রার্থনা মঞ্জুর করে বললেন- বেশ, তাই নাও। বিষ্ণু এবার স্বরূপ ধারণ করলেন। এক পায়ে তিনি পৃথিবী অধিকার করলেন, আর এক পদক্ষেপে স্বর্গ অধিকৃত হল। বিষ্ণু বললেন, তৃতীয় পদ কোথায় স্থাপন করি? মহাবলী বললেন, আমার মস্তকে। বিষ্ণুর পদভারে মহাবলী রসাতলে প্রোথিত হলেন।
প্রজারা কান্নাকাটি শুরু করল। তাদের পীড়াপীড়িতে পরে বিষ্ণু প্রতি বছর একদিনের জন্য মহাবলীকে নিজের রাজধানীতে ফিরে যাবার অনুমতি দিলেন। সে দিনটিই দীপাবলি বা দেওয়ালি। লোকজন নরপতিকে নিজেদের মধ্যে ফিরে পেয়েছিলেন বলেই প্রজারা সেদিন আলোর উৎসব করেছিল। দীপাবলির এই দিনে প্রজারা কল্যাণকামী রাজার প্রত্যাবর্তনের আশায় দীপ জ্বেলে অপেক্ষা করে।
কেউ কেউ এমনও বলেন, মহামায়া দুর্গা এদিনেই অসুর বধ করে ত্রিলোককে নিশ্চিন্তে আলো জ্বালতে দিয়েছিলেন।
আরও অনেক জায়গাতেই অনেক উপলক্ষে পালিত হয় আলোর উৎসব।
এত আলোর মাঝে অন্ধকার থাকে কি করে? একটি একটি দীপ করে কোটি কোটি দীপ জ্বলে ওঠে। পৃথিবীর প্রতিটি কোনে কেউ না কেউ কোন না কোন বিশ্বাসে দীপাবলির আলোয় জীবনের গান গায়। পূর্ব পুরুষের স্মরণ করে আর তাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে। তাদের আশীর্বাদ প্রার্থনা করে।
দীপাবলির উৎসবে কবে যে ভাগ বসাল আতশবাজি তা বলা মুশকিল ।
এ এক ভয়ংকর ভাইরাস, শব্দ দূষণ। অঞ্চলভেদে দীপাবলি বারুদের উৎসবে পরিণত হয়েছে। শিশু কিশোর যুবক এমনকি সমঝদার প্রাপ্ত বয়স্ক রাতের পর রাত প্রতিযোগিতা করে আতশবাজি ফোটায়। এ অসুস্থ সংস্কৃতি মঙ্গল ও আলোর উৎসব দীপাবলির কলঙ্ক। অজ্ঞানীদের এ থেকে বিরত রাখতে হবে। নতুবা অনেক ধর্মের উৎসব দীপাবলি হারাবে তার গুরুত্ব।
সভ্যতার শেষ মানুষটি বেঁচে থাকা পর্যন্ত জ্বলবে দীপাবলির আলো। অন্ধকারের সামর্থ্য নেই এ আলোকে অতিক্রম করে।
হুমায়ুন আজাদ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের দীপ জ্বালানোর জন্য লিখলেন লাল নীল দীপাবলি। মানব মনের অন্ধকার দূর করতে সবার তরে জানাই লাল নীল শুভ দীপাবলি।
উপনিষদের অমৃত বাণী পাঠ করি। আলোর পথে যাওয়ার জন্য মানুষের চিরায়ত প্রার্থনা-
অসতো মা সত্গময়।
তমসো মা জ্যোতির্গময়।
মৃত্যোর্মা অমৃতংগময়।
ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ।।
অর্থাৎ, হে ঈশ্বর, আমাকে অসৎ হতে সত্যে নিয়ে যাও, অন্ধকার হতে জ্যোতিতে নিয়ে যাও, মৃত্যু হতে অমরত্বে নিয়ে যাও। সর্বত্র যেন ছড়িয়ে পড়ুক শান্তির বার্তা।
আরও পড়ুনঃ খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির দুই ডিলারের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ