![বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী](https://www.durjoybangla.com/media/imgAll/2023November/Haider-Jahan-Chowdhury-2312030550.jpg)
বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী
মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। মুক্তিযোদ্ধা তথা জাতির বীর সন্তানেরা কোন পরিবার বা গোষ্ঠীর নয় তারা পুরো বাঙ্গালী জাতির অহংকার।
জাতীয় সাহিত্যিক বাংলা একাডেমী ও একুশে পদক প্রাপ্ত লেখক জনাব খালেকদাদ চৌধুরী ও বেগম হামিদা চৌধুরীর কণিষ্ট পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক হায়দার জাহান চৌধুরীর জন্ম ৭ জুলাই ১৯৫০ ইং মসজিদ কোয়ার্টার নেত্রকোণাতে। ব্যক্তিগত জীবনে দুই কন্যা সন্তানের পিতা হায়দার জাহান চৌধুরী।
শিক্ষা জীবন:
নেত্রকোণা দত্ত উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যট্রিক, নেত্রকোণা সরকারী কলেজ থেকে বিএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস এম এ ২য় বর্ষ ছাত্র অবস্থায় বাংলাদেশ রেডক্রস এর ইউনিট অফিসার হিসাবে চাকুরিতে যোগদান করেন। স্কুল জীবন থেকেই শিশু সংগঠন কচিকাঁচা মেলার সদস্য হিসাবে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতি ও খেলাধুলার মাধ্যমে কিশোর ও যৌবনের দূরন্তপনার মধ্য দিয়ে তার পথ চলা শুরু। ১৯৬৩ সনের জানুয়ারি মাসে কিংবদন্তী ছাত্রনেতা জনাব মেহের আলীর হাতে গড়া সংগঠন মধুমাছি কচিকাঁচার মেলার আহ্বায়ক হিসাবে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের নেতৃত্বে গুণগত মান অর্জনের পাশাপাশি খেলাধুলায় বিশেষ করে একজন চৌকস ফুটবলার হিসাবে আন্তঃস্কুল, আন্তঃকলেজ ও আন্ত:বিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টগুলোতে অংশগ্রহন করেন।
এছাড়া ঢাকা ও ময়মনসিংহ ফুটবল লীগে বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে অংশগ্রহন। একজন খ্যাতিমান ফুটবল খেলোয়ার হিসাবে তৎকালিন মহকুমা ও জেলার গন্ডি পেরিয়ে জাতীয় পর্যায়ে সুনাম অর্জন করেছেন।
রাজনৈতিক জীবন:
৬০ ও ৭০ দশকের ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ায় খেলাধুলার জীবনের অনেকটা ভাটা পরে যায়। নেত্রকোণা কলেজের ছাত্র অবস্থায় হায়দার জাহান চৌধুরী ৬০ দশকের ছাত্র রাজনীতিতে ছাত্রলীগের হয়ে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন সহ তৎকালিন পাকিস্তানের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে একজন বলিষ্ট ছাত্রকর্মী হিসাবে নেত্রকোণার ছাত্র আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৬২ সালে নেত্রকোনা মহকুমা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে হায়দার জাহান চৌধুরীর রাজনীতির পথ চলা শুরু হয়। ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাকালীন অন্যান্য সদস্য যারা ছিলেন তারা হলেন সভাপতি জনাব মেহের আলী ও সেক্রেটারী জনাব শামসুজ্জোহা,জনাব জামাল উদ্দিন আহম্মেদ, বিপ্লব চক্রবর্তী, মতিয়র রহমান খান, শহিদ উদ্দিন আহমেদ, আব্দুল ওয়াহেদ, আ: মান্নান, আব্দুর রহমান, আলাউদ্দিন খান, আশরাফ আলী খান খসরু, ধীমান রঞ্জন বিশ্বাস (ভারত প্রবাসী) (জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন পূর্বপাকিস্তান আওয়ামীলীগের ছাত্র সংগঠন)। ১৯৬৪ সালে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে প্রথম শহীদ মিনারের অন্যতম স্থপতিও হায়দার জাহান চৌধুরী। সব আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু দত্ত উচচ বিদ্যালয়ের উত্তর পশ্চিম কোণে কাচারি রোডের সংযোগস্থলে তিন রাস্তার মোড়ে বর্তমান শহীদ মিনারের প্রধান গেইটের জায়গায় তৎকালীন নেত্রকোণা মহকুমা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সর্বজনাব মেহের আলী (জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন পূর্বপাকিস্তান আওয়ামীলীগের ছাত্র সংগঠন), প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী শামসুজ্জোহা, জামাল উদ্দিন আহমেদ( জনাব মেহের আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাবার পর সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়), মতিউর রহমান খান, আশরাফ আলী খান (খসরু), গাজী মোশারফ হোসেন, হাবিবুর রহমান খান(খসরু), সাখাওয়াত হোসেন এর নেতৃত্বে প্রথম শহীদ মিনারটি স্থাপিত হয়। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ৫০ পূর্ব বাংলার রাজনীতি ছিল মূলত আঞ্চলিক দশকে স্বায়ত্বশাসনের দাবীকে কেন্দ্র করে। যার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৬ দফা দাবীর মধ্যে দিয়ে। ৬ দফা ও ১১ দফা দাবীর ভিত্তিতে গড়ে উঠা ছাত্র আন্দোলন, গণ আন্দোলনে রূপ নেয়। এবং পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতনের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবের মুক্তি ও ৭০ এর নির্বাচন এর প্রতিটি আন্দোলনে নেত্রকোণার ছাত্রলীগ নেতা হিসাবে হায়দার জাহান চৌধুরীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা আজও অম্লান।
কর্মজীবন:
মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে বিভিন্ন সামাজিক, সংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে জড়িত থেকে সমাজ উন্নয়নে কাজ করেছেন। তিনি এখনো এসব কজে নিজেকে জড়িত রেখেছেন। নেত্রকোণা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার হিসাবে দীর্ঘদিন মুক্তিযোদ্ধাদের খ্যাতি অর্জন। জীবন মান উন্নয়নে কাজ করেছেন। বর্তমানে তিনি একটি জাতীয় দৈনিকে জেলা প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করছেন এবং বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি জেলা ইউনিটের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া নেত্রকোণা জেলা প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি হিসাবে দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। নেত্রকোণার বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন অসংগতি, অনাচার, অত্যাচার, নির্যাতনসহ সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে বলিষ্ট ভূমিকা পালন করছেন। তিনি নেত্রকোণা সাধারণ গ্রন্থাগারের দীর্ঘ নয় বছর (১৯৯০-৯৮) সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। নেত্রকোণা সামাজিক সংগঠন জন উদ্যোগ এর নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসাবে জনগণের বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে জনগণের চাহিদা ও প্রত্যাশা পুরনে উদ্যোগ গ্রহনের মাধ্যমে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ সহ-নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধ, নারী অধিকার ও ক্ষমতায়ন, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ নির্মূল, মাদক ও দুর্নীতি মুক্ত সমাজ ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনে একজন নির্ভীক কর্মী হিসাবে সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করার কাজে হায়দার জাহান চৌধুরী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। তিনি নেত্রকোণা উন্নয়নে নাগরিক আন্দোলন এর একজন সক্রিয় সদস্য হিসাবে নগর ও নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি জেলার বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সেবা মূলক প্রতিষ্ঠানের সাথে নিজকে জড়িত রেখে সমাজ সেবা মূলক কর্মকাণ্ড সহ জেলার সর্বিক উন্নয়নে কাজ করছেন ।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান:
৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে তৎকালিন নেত্রকোণা মহকুমা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে নেত্রকোণা স্বাধীনতাকামি ছাত্র যুবকদেরকে সংগঠিত করে মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি অংশগ্রহন করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল চালিকা শক্তি ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসাবে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে সময়ের সাহসী সন্তান হিসাবে হায়দার জাহান চৌধুরী স্বাধীনতাযুদ্ধের একজন গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন। ১লা মার্চ ‘৭১ থেকে শুরু হওয়া স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ সংগ্রামে নেত্রকোণার ছাত্র জনতার সশস্ত্র মিছিলে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন, স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে নিরস্ত্র আন্দোলনকে সশস্ত্র আন্দোলনে রূপদান করতে গিয়ে হায়দার জাহান চৌধুরী যথাযথ ভাবে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে জয়বাংলা বাহিনী গঠন ও পুলিশ অস্ত্রাগার লুন্ঠন করে সশস্ত্র মুক্তিবাহিনী গঠন, সেই সাথে স্বাধীনতার ইসতেহার বিতরণসহ সীমান্ত এলাকায় ইপিআর ক্যাম্পগুলো বাঙ্গালী সৈনিকদের নিয়ন্ত্রণে এনে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করানো, মুক্তিযুদ্ধের সুচনালগ্নে এসব দু:সাহসীক কর্মকাণ্ডে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। পরবর্তীতে তিনি ছাত্রলীগ নেতা হিসাবে ভারতের দেরাদুন ক্যান্টনমেন্ট থেকে বিশেষ গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে ১১ নং সেক্টরে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) মুজিব বাহিনীর অন্যতম কমন্ডার হিসাবে ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ এলাকার বিভিন্ন থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধকে সংঘঠিত করে দীর্ঘমেয়াদী জনযুদ্ধে রূপান্তরিত করার মহান দায়িত্ব পালনসহ হানাদার বাহিনীর বিরোদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন ।
পুরষ্কার ও সম্মানণা:
ষাটের দশকে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য “Bangladesh Muktijudho Research Institute Silver Award-2022” , ভাষা সৈনিক আবুল হোসেন কলেজ ও লোকসাহিত্য গবেষণা একাডেমি সম্মাননা স্মারক ২০২২ এবং মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক কমান্ড সম্মাননা ২০২২ প্রদান করা হয়।
আরও পড়ুন: ছাত্রলীগ থেকে মুজিব বাহিনী